ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক
এলএনজি, ভোজ্যতেল-ডাল ও সার কিনবে সরকার
প্রকাশ | ২৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
দেশে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের জন্য স্পট মার্কেটের সর্বনিম্ন দরদাতা সুইজারল্যান্ডের টোটাল এনার্জিস কোম্পানি থেকে এক কার্গো তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতে ব্যয় হবে ৪৭০ কোটি টাকা। এছাড়া স্থানীয়ভাবে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে এক কোটি ২০ লাখ লিটার ভোজ্যতেল ও ২০ হাজার টন মসুর ডাল এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চুক্তির আওতায় বিভিন্ন দেশ থেকে দুই লাখ ৬০ হাজার টন সার আমদানির প্রস্তাবসহ আরও ১১ ক্রয়প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। এতে ব্যয় হবে এক হাজার ৫৩৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা।
মঙ্গলবার সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির আহ্বায়ক অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত নতুন সরকারের অধীনে কমিটির প্রথম সভায় প্রস্তাবগুলোর অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রস্তাবের মধ্যে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের একটি, কৃষি মন্ত্রণালয়ের ৪টি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ৩টি এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের ৪টি প্রস্তাব রয়েছে। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সাংবাদিকদের বিস্তারিত জানানো হয়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ জানায়, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে সুইজারল্যান্ডের টোটাল এনার্জিস গ্যাস অ্যান্ড পাওয়ার লিমিটেড থেকে এক কার্গো এলএনজি আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। প্রতি এমএমবিটিইউ ১০ দশমিক ৮৮ মার্কিন ডলার হিসেবে ৩৩ লাখ ৬০ হাজার এমএমবিটিইউ এলএনজি আমদানিতে মোট খরচ হবে ৪৭০ কোটি ৪৮ লাখ ৬০ হাজার ১৬০ টাকা।
এ বিষয়ে আরও জানানো হয়, অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির (সিসিইএ) অনুমোদনে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনার জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত ২২টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মাস্টার সেল অ্যান্ড পার্সেস এগ্রিমেন্ট (এমএসপিএ) সই চূড়ান্ত হয়। পেট্রোবাংলা এক কার্গো এলএনজি সরবরাহের জন্য ২২টি প্রতিষ্ঠান থেকে দরপ্রস্তাব আহ্বান করলে দুটি প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব দাখিল করে।
দরপত্রের সব প্রক্রিয়া শেষে প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ কমিটির (পিপিসি) সুপারিশে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান সুইজারল্যান্ডের টোটাল এনার্জিস গ্যাস অ্যান্ড পাওয়ার লিমিটেড থেকে এলএনজি আমদানির অনুমোদনের প্রস্তাব করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।
এদিকে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, 'বিদু্যৎ ও জ্বালানির দ্রম্নত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধনী ২০২১)'- এর আওতায় মাস্টার সেল অ্যান্ড পার্সেস এগ্রিমেন্ট (এমএসপিএ) সই করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য থেকে কোটেশন সংগ্রহ প্রক্রিয়ায় স্পট মার্কেট থেকে এ এলএনজি আমদানি করা হবে। এটি ২০২৪ সালের তৃতীয় এলএনজি আমদানির ক্রয় প্রস্তাব।
সূত্রটি জানায়, এলএনজির মূল্য অস্বাভাবিক বাড়ায় ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ এর জানুয়ারি পর্যন্ত স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এ পরিস্থিতিতে চাহিদার তুলনায় গ্যাসের সরবরাহ কম থাকায় বিদু্যৎ উৎপাদন, ক্যাপটিভ বিদু্যৎ ও শিল্পখাতে স্বাভাবিক গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে। ফলে ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে গ্যাস সরবরাহ নির্বিঘ্ন করার দাবি ওঠে।
এরপর 'বিদু্যৎ ও জ্বালানির দ্রম্নত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধনী ২০২১)'- এর আওতায় মাস্টার সেল অ্যান্ড পার্সেস এগ্রিমেন্ট (এমএসপিএ) সই করা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আবার স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি হচ্ছে। দেশে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের জন্য স্পট মার্কেট থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালে জুন পর্যন্ত মোট ১৩ কার্গো এলএনজি কিনতে বিদু্যৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে।
তেল-ডাল কেনার সিদ্ধান্ত
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, টিসিবি কর্তৃক ৩টি লটে ১ কোটি ২০ লাখ লিটার রাইস ব্রান তেল এবং ২০ হাজার মেট্রিক টন মসুর ডাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
দর প্রস্তাবের সব প্রক্রিয়া শেষে টিইসি কর্তৃক নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে সুপারিশ করা মজুমদার প্রোডাক্ট, মজুমদার ব্রান অয়েল মিলস এবং আলী নেচারাল অয়েল মিলস অ্যান্ড এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজের নিকট থেকে ১ কোটি ২০ লাখ লিটার রাইস ব্রান তেল ১৮৯ কোটি ৬০ লাখ টাকায় সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে ক্রয়ের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে কমিটি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আর এক প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের উমা এক্সপো প্রাইভেট লিমিটেড থেকে ১০ হাজার মেট্রিক টন মসুর ডাল কেনার প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই ডাল কিনতে ৯৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যয় হবে। প্রতি কেজি মসুর ডালের দাম পড়বে ১০১ টাকা ১৩ পয়সা।
এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বগুড়ার রয় এগ্রো ফুড প্রোডাক্টস এবং ঢাকার নাবিল নবা ফুডস লিমিটেড থেকে ১০ হাজার মেট্রিক টন মসুর ডাল কেনার প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা কমিটি। এই ডাল কিনতে খরচ হবে ১০৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। প্রতি কেজি মসুর ডালের দাম পড়বে ১০৫ টাকা ৪৫ পয়সা।
এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডধারী ১ কোটি পরিবারের নিকট ভর্তুকি মূল্যে বিক্রির লক্ষ্যে ১০ হাজার মেট্রিক টন মসুর ডাল কেনার জন্য স্থানীয়ভাবে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করা হলে ২টি দর প্রস্তাব জমা পড়ে। ২টি দর প্রস্তাবই কারিগরিভাবে রেসপনসিভ হয়।
দর প্রস্তাবের সব প্রক্রিয়া শেষে টিইসি কর্তৃক সুপারিশকৃত রেসপনসিভ সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান বগুড়ার রয় এগ্রো ফুড প্রোডাক্টস এবং ঢাকার নাবিল নবা ফুডস লিমিটেডের নিকট থেকে ১০ হাজার মেট্রিক টন মসুর ডাল প্রতি কেজি ১০৫ টাকা ৪৫ পয়সা হিসেবে ১০৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকায় ক্রয়ের অনুমোদনের জন্য প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি প্রস্তাবটি অনুমোদন দিয়েছে।
দুই লাখ ৬০ হাজার টন সার
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ জানায়, ২ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন সার কেনার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার। এর মধ্যে ১ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া, ৮০ হাজার মেট্রিক টন ডিএপি, ৩০ হাজার মেট্রিক টন টিএসপি এবং ৩০ হাজার মেট্রিক টন এমওপি রয়েছে। স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠান এবং সৌদি আরব, রাশিয়া, কাতার ও মরক্কোর প্রতিষ্ঠান থেকে এ সার কেনার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার। যা কিনতে প্রায় ১ হাজার ১৪২ কোটি টাকা খরচ হবে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে ডিএপি, টিএসপি এবং এমওপি সার কেনার চারটি প্রস্তাব নিয়ে আসা হয়। চারটিই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের চুক্তির আওতায় সৌদি আরর'র মা'আদেন থেকে ৪০ হাজার মেট্রিক টন ডিএপি সার আমদানি করা হবে। এ সার আমদানির ব্যয় ধরা হয়েছে ২৫৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) মাধ্যমে এ সার আমদানি করা হবে।
বিএডিসি'র মাধ্যমে মরক্কোর ওসিপি এসএ থেকে আমদানি করা হবে ৩০ হাজার মেট্রিক টন টিএসপি সার। এ সারও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের চুক্তির আওতায় আমদানি করা হবে। এ সার আমদানির খরচ ধরা হয়ছে ১ কোটি ১৫ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার। সমপরিমাণ বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।
একই সঙ্গে মরক্কো'র ওসিপি থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের চুক্তির আওতায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন ডিএপি সার আমদানি করার প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। এ সার আমদানি করতে খরচ ধরা হয়েছে ২ কোটি ১৯ লাখ মার্কিন ডলার, সমপরিমাণ বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৪০ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের আর একটি প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে রাশিয়া থেকে ৩০ হাজার মেট্রিক টন এমওপি সার আমদানি করা। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে রাশিয়ার জেএসসি ফরিং ইকোমিক করপোরেশন 'প্রোডিন্টরগ' ও বিএডিসি'র মধ্যে সই হওয়া চুক্তির আওতায় চতুর্থ লটে এ সার আমদানি করা হবে। এ সার আমদানিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯০ লাখ ৬৩ হাজার মার্কিন ডলার, সমপরিমাণ বাংলাদেশি মুদ্রায় ৯৯ কোটি ৬৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
এছাড়া সৌদি আরব ও কাতারের প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠান থেকে সার কিনতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের চারটি প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কাতারের কাতার কেমিক্যাল অ্যান্ড পেট্রোকেমিক্যাল মার্কেটিং অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (মুনতাজাত) থেকে ৩০ হাজার মেট্রিক টন বাল্ক গ্র্যানুলার ইউরিয়া সার কেনা হবে। রাষ্ট্রীয় চুক্তির মাধ্যমে এ সার কিনতে খরচ ধরা হয়েছে ৯৪ লাখ ২ হাজার ৬০০ মার্কিন ডলার, সমপরিমাণ বাংলাদেশি মুদ্রায় ১০৩ কোটি ৪২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের বাকি তিন প্রস্তাবের মধ্যে সৌদি আরবের সাবিক এগ্রি-নিউট্রিয়েন্টস কোম্পানি থেকে ইউরিয়া সার কেনার দুটি প্রস্তাব রয়েছে। রাষ্ট্রীয় চুক্তির আওতায় সৌদি আরবের এ প্রতিষ্ঠান থেকে ৩০ হাজার মেট্রিক টন করে দুই লটে মোট ৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার আমদানি করা হবে।
প্রতি লটের জন্য ৯৪ লাখ ২ হাজার ৬০০ মার্কিন ডলার বা সমপরিমাণ বাংলাদেশি মুদ্রায় ১০৩ কোটি ৪২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা ব্যয় হবে। অর্থাৎ ৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার আমদানি করতে মোট খরচ হবে কোটি ২০৬ ৮৫ লাখ ৭২ হাজার টাকা।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের বাকি প্রস্তাবটিও ইউরিয়া সার কেনা সংক্রান্ত। দেশীয় প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (কাফকো) থেকে ৩০ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া সার কেনা হবে। কাফকো থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৩তম লটে এই ইউরিয়া কেনা হবে। এতে মোট ব্যয় হবে ৯৪ লাখ ৯৮ হাজার ৭৫০ মার্কিন ডলার বা সমপরিমাণ বাংলাদেশি মুদ্রায় ১০৪ কোটি ৪৮ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা।