কৃষকদের হাসি নেই বিখ্যাত আলুর মাঠগুলোতে, এখন শুধুই মলিন মুখে চিন্তার ছাপ। দিন যতই যাচ্ছে বৈরী আবহাওয়ার কারণে আলুর ক্ষেতে রোগবালাই ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে কৃষকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। তাদের হাজারো স্বপ্ন এখন পচে যাচ্ছে। বগুড়ার শত শত হেক্টর জমির আলুগাছ ধীরে ধীরে নেতিয়ে মাটিতে মিশে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে পাতাগুলোতে পচন ধরে বেশিরভাগ ঝরে গেছে। কৃষকরা তাদের নিজেদের কৌশল, শ্রম ও কৃষি বিভাগের সহযোগিতা ছাড়াও বিভিন্ন নামি-বেনামি কোম্পানির লোকের পরামর্শ ও নানারকম ওষুধ ছিটিয়ে নিজেরাই নাজেহাল হয়ে পড়েছে। মানসিকভাবে তারা এখন অনেকটাই দুর্বল।
শস্যভান্ডার খ্যাত বগুড়া আলু চাষে দেশের অন্যতম। ওখানকার আলু নিজেদের চাহিদা পূরণের পরেও প্রায় ১০ লাখ টন দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। জাত ভেদে স্বাদের আলু চাষ হয়ে থাকে বগুড়াতেই। আলু মজুতের দিক থেকেও কম নয়। অর্থাৎ সংকট মুহূর্তে বগুড়ার আলুর ওপর নির্ভর করে দেশের বাজার।
২০১৮ সালে আলু চাষ করে বেশ লাভবান হয়েছিল কৃষকরা, তবে কৃষকদের চেয়ে ব্যবসায়ীদের পকেটটাই বেশি ভারী হয়েছিল। এর পর ২০২৩ সালে অস্থির হয়ে ওঠে আলুর বাজার, যার প্রভাব ২০২৪ সালেও
কমেনি। এমন বাজার দেখে এবার বগুড়ার আলু চাষিরা একটু বেশিই ঝুঁকে পড়ে। অর্থাৎ গত বছর জেলায় আলু চাষ হয়েছিল ৫৩ হাজার ২১৫ হেক্টর জমিতে এবার চাষ হয়েছে ৫৫ হাজার ২৬০ হেক্টরে।
বিগত দিনের চেয়ে আলু চাষে খরচ বেড়েছে অনেকটাই বেশি। এরই মধ্যে নানা ধরনের রোগের কারণে কীটনাশক ও পচন নিবারক ওষুধ ব্যবহার করে দ্বিগুণ খরচ হয়ে যাচ্ছে। এতে লাভতো দূরের কথা আক্রান্ত জমিগুলো থেকে প্রতি বিঘায় ১০-২০ মণ আলু পাওয়াটাই কৃষকদের ভাগ্যের ব্যাপার। বগুড়ার জমিগুলোতে ভালো ফলন হলে প্রতি বিঘায় ৮০ থেকে ১০০ মণ পর্যন্ত আলু হয়ে থাকে। কিন্তু নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ায় এবার বিঘায় কত মণ হবে তা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।
উফশী জাতের গাছগুলোতে এখন শিকড় থেকে আলু বের হয়ে মার্বেল আকৃতির হয়েছে। এসব আলু পরিপক্ব হতে আরও প্রায় ২০ থেকে ৩৫ দিন সময় লাগবে। এরই মধ্যে ভয়ংকর রূপে হানা দিয়েছে নেটবস্নাইট (নাভি ধস) রোগ। এই রোগে গাছের পাতা পুরে ও পচে যাচ্ছে। যা থেকে রক্ষা পাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। কারণ এক রাতেই এই রোগ যেসব জমিতে আক্রমণ করেছে সেসব জমিতে ওষুধ স্প্রে করে আর কোনো কাজ হচ্ছে না। কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্যানুযায়ী প্রায় একশ ২০ হেক্টর জমিতে এই রোগ দেখা দিয়েছে।
সরেজিন শিবগঞ্জ উপজেলার বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বললে তারা এই ঘটনার কথা জানান। এদের মধ্যে চকভোলাক এলাকার মজিবর রহমান নামে এক কৃষক তার আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, "'এক রাতের শিতলী ঘোড়ায় এই রোগ দেখা দেয়" অর্থাৎ সারাদিন গরমের পরে রাতে প্রচন্ড ঠান্ডা হওয়ায় আমার দুই বিঘা মাটিতে এই রোগ দেখা দেয়। আমি ৫ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলাম। এটা দেখার পর ঐদিন সকাল থেকেই ওষুধ ছিটাতে শুরু করি এতে অন্য ৩ বিঘার আলুর গাছ ঠিক আছে। এতে করে আমি মনে করি প্রথম থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করে ওষুধ প্রয়োগ করলে এই রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।' তিনি আরও বলেন, 'নিজেদের রাখা বীজের চেয়ে অফিস থেকে বীজ সংগ্রহ করে চাষাবাদ করলে এই রোগ কম হয় এবং ফলনও ভালো হয়। তবে বিএডিসি থেকে নেয়া বীজে এবার এই রোগ বেশি হয়েছে।'
নন্দীগ্রাম উপজেলার খরনা ইউনিয়নের কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বললে তারাও একই কারণ বলেন। খরনা এলাকার কৃষক গোলাম মোস্তফা বলেন, 'বেশি ঠান্ডা এই রোগের আসল কারণ নয়। গরম থেকে হঠাৎ ঠান্ডা আবহাওয়া হওয়ায় এক রাতেই এই রোগ দেখা দেয়। প্রথমে দু-একটি পাতাতে পাচারি দেখা দেয় এর পর দু-চার দিনের মধ্যেই পুরো জমিতে ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগ এক জমি থেকে অন্য জমিতেও ছড়ায় অর্থাৎ কোনো জমিতে দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে আশপাশের জমিতে ওষুধ প্রয়োগ করলে এই পচারি রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।'
এ বিষয়ে বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মতলুবর রহমান বলেন, 'বিগত কয়েকদিনের বৈরী আবহাওয়ার কারণে আমাদের আলুতে লেটবস্নাইট বা নাভি ধসা আক্রমণের দেখা দেয়। তবে আমরা প্রথম থেকেই কৃষক ভাইদের পরামর্শ দিয়ে আসছি যে, এই ছত্রাকজনিত রোগ যেন না ক্ষতি করতে পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে এবং মেনকোজেব নামের ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ৩ গ্রাম হারে মিশিয়ে প্রতি শতাংশ জমিতে ২ লিটার হারে গাছের পাতার উপরে ও নিচে এছাড়া ডগা পর্যন্ত যেন পৌঁছায় সেদিকে লক্ষ্য রেখে স্প্রে করতে হবে।'
তিনি জানান, 'আমরা সাধারণত প্রতি সপ্তাহে একবার স্প্রে করার পরামর্শ দিয়ে থাকি কিন্তু যখন একেবারেই বৈরী আবহাওয়া দেখা দেয় তখন প্রতি ৪-৫ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।'
বগুড়ায় ইতোমধ্যে জমি থেকে আলু সংগ্রহ শুরু হয়েছে এ পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমির আলু উত্তোলন করা হয়েছে। আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে পুরোদমে আলু তোলার কাজ শুরু হয়ে যাবে। বিগত কয়েক বছরের চেয়ে এবার আলুগাছের চেহারা অনেকটাই ভালো এতে করে কৃষকরা আশা করছেন আগামী কয়েক দিন যদি রোগবালাই থেকে রক্ষা পাওয়া যায় তাহলে ভালো ফলন পাওয়া যাবে।
কৃষকদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী এবার প্রতি বিঘা আলুতে ২৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। এর মধ্যে এক বিঘা জমিতে ১৫-২০ হাজার টাকার বীজ, প্রায় ১০ হাজার টাকার সার, চাষ ও শ্রমিকের মজুরি প্রায় ১০ হাজার ও ৭-১০ হাজার টাকার ওষুধ ছিটাতে হচ্ছে। এছাড়া বেশিরভাগ কৃষক জমি পত্তন নিয়ে চাষাবাদ করে থাকে। এসব জমি প্রতি ১ বিঘা বছরে ১৫-২০ হাজার টাকা পত্তন দিতে হয়। এক বিঘা জমি থেকে ভালো ফলন হলে ১০০ মণ আলু পাওয়া যায়। এতে প্রতি মণ আলু ৮০০ টাকা দরে বিক্রয় না করতে পারলে লাভ হয় না। কৃষকরা বলেন প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নানা ধরনের রোগবালাই আছেই অর্থাৎ অনেক বড় ঝুঁকি নিয়েই আলু চাষ করতে হয়।
বগুড়ায় আলু চাষে বিখ্যাত উপজেলা হিসেবে শিবগঞ্জকেই চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া উলেস্নখযোগ্য হিসেবে নন্দীগ্রাম, কাহালু, সাজাহানপুর, শেরপুরসহ প্রত্যেক জেলায়ই আলু চাষ হয়ে থাকে। জেলায় এবার উফশী জাতের মধ্যে সব থেকে বেশি চাষ হয়েছে এস্টারিক্স। এই জাতের আলু চাষ হয়েছে ১৭,৪৫০ হেক্টর। এছাড়া কার্ডিনাল ৮,৭৫০ হে., গ্রানুলা ৬,৬৫০ হে., ডায়মন্ট ৪,৩২৫ হে.। স্থানীয় জাতের মধ্যে ফাটা পাকড়ি ৩,০৪০ হে., লাল পাকড়ি ২১০৫ হে., রোমানা পাকড়ি ৮১০ হে.। এছাড়া এলভিড়া, ক্যারেজ, মিউজিক, লেডি রোজো, তেল পাকড়ি, সাদা পাকড়ি, পাহাড়ি পাকড়ি, হাগড়াইসহ নানা জাতের আলু চাষ হয়েছে বগুড়ায়।