ধানের জেলা হিসেবে খ্যাতি পাওয়া দিনাজপুর জেলা আলু উৎপাদনেও ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। বিগত কয়েক বছর থেকে আগাম আলু চাষে ঝুঁকছেন এ জেলার কৃষকরা। এক জমিতে আলুসহ তিন ফসলের চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর, বিরল ও সদর উপজেলার কয়েকটি এলাকা ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবার গত কয়েক বছরের তুলনায় আগাম আলু চাষ করে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। পরপর গত তিন বছর লাভের মুখ না দেখলেও এবারে লাভের হিসাব কষছেন তারা।
চিরিরবন্দর উপজেলার ভোলানাথপুর এলাকার কৃষক জামালউদ্দিন বলেন, 'আড়াই বিঘা মাটিত আগাম আলু লাগাইছি। জমি নিজের। এ পর্যন্ত দুই বিঘা মাটির আলু উঠাইছি। গড়ে দুই বিঘা জমিতে আলু পাইছি ১২০ মণ। গড়ে ৩৮ টাকা কেজি দর পাইছি। এইবার আগাম আলু লাগায়াই তাহো দুইটা টাকার মুখ দেখানো।'
কৃষি অফিস সূত্র জানায়, সাধারণত নভেম্বর মাসের শেষভাগ হতে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত আলু লাগানোর সময়। তবে কৃষকরা জমি ফেলে রাখতে চান না দেখে আগাম আমন লাগান। ধান কাটা শেষ হলে সেই জমিতে আগাম আলু লাগান। এ অঞ্চলে আগাম জাত হিসেবে সানশাইন, সেভেন, স্টোরেজ এবং লেট ভ্যারাইটি হিসেবে কার্ডিনাল, গ্যানুলা, ডায়মন্ড, বারি-১০ ও দেশি (লাল) জাতের আলুর চাষ করে থাকেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী এ জেলায় এবার ৪৬ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আলু লাগিয়েছেন কৃষক। হেক্টর প্রতি ফলনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭ মেট্রিক টন। গত বছরের তুলনায় দেড় হাজার হেক্টর জমিতে বেশি আলু চাষ হয়েছে। আর রোপণকৃত মোট আলুর ২৫ শতাংশ আগাম চাষ করা হয়েছে।
এদিকে দিনাজপুরের বাহাদুর বাজার ঘুরে দেখা যায়, নতুন জাতের আলু আকারভেদে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৪০-৪২ টাকা দরে। কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, পাইকারি বাজারে আলুর দাম ৩৯-৪১ টাকা। বাজারে কোনো দোকানেই পুরাতন আলুর দেখা পাওয়া যায়নি। তবে কয়েক দিনের মধ্যে আলুর বাজার নেমে যাবে এমন কথাই বলছেন সবজি ব্যবসায়ীরা, তাদের ভাষ্য- 'আগাম জাতের আলুটা পুরোপুরি বাজারে আসলে দাম কিছুটা কমবে। যা উঠছে তার একটা অংশ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আরও সপ্তাহখানেক পরে আলু ৩০-৩৫ টাকা কেজিতে চলে আসতে পারে।'
কিছু দিন আগে হঠাৎ আলুর দাম বৃদ্ধি নিয়ে এক ব্যবসায়ী বলেন, 'এখানে খুচরা ব্যবসায়ীদের হাত নেই। পাইকারি যে দামে কিনি তার চেয়ে ৩-৫ টাকা লাভে আমরা বিক্রি করি। এক্ষেত্রে হিমাগারে আলু রেখে যারা ব্যবসা করেন মূলত দামটা তারাই নিয়ন্ত্রণ করেন।'
জানা গেছে, 'দিনাজপুরে মোট ১৪টি হিমাগার আছে। এসব হিমাগারের ধারণক্ষমতা প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন।
পূণর্ভবা কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী বলেন, 'দিনাজপুরের হিমাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার চাইতে কমপক্ষে ৬০ হাজার মেট্রিক টন আলু বেশি থাকে। চাহিদার তুলনায় উৎপাদনও বেশি হয়। হিমাগার মালিক প্রতি বস্তা (৫৫ কেজি) ভাড়া বাবদ পান ২৮০ টাকা। আলুর দাম বাড়ল কিন্তু সেই বাড়তি টাকা কৃষকের ঘরে যায়নি। এখানে একটা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট আছে যারা গুজব ছড়িয়ে দামটা নিয়ন্ত্রণ করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।'
দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার কারেন্ট হাট বাজার এলাকায় পাঁচ হাজার টাকা বিঘা হিসেবে দেড় বিঘা (৪৮ শতকে বিঘা) জমি চুক্তি নিয়ে আগাম আলু লাগিয়েছেন কৃষক আলাউদ্দিন হোসেন (৪১)। গত বছর নভেম্বর মাসের ১ তারিখে 'স্টোরেজ' জাতের আলু রোপণ করেছেন তিনি। ৬২ দিন বয়সে সোমবার আলু উত্তোলন করেছেন। তাতে আলু পেয়েছেন ৫২ মণ (৩২ বস্তা, প্রতি বস্তা ৬৫ কেজি)। ক্ষেত থেকেই সেই আলু পাইকারের কাছে বিক্রি করেছেন ৪২ টাকা কেজি দরে। কৃষি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী আলু উত্তোলনের সময়কাল ধরা হয় ৮৫-৯০ দিন। তাহলে ৬২ দিন বয়সে কৃষক আলমগীর আলু উত্তোলন করছেন কেন? আলমগীর জানান, আগাম আলু লাগিয়েছেন। বাজারে নতুন আলুর চাহিদা আছে। ক্ষেত থেকে পাইকারের কাছে বিক্রি করছেন ৪২ টাকা কেজি দরে। ৯০ দিন সময় নিয়ে আলু উত্তোলন করলে হয়তো ৭০ মণ পর্যন্ত আলু পাবো কিন্তু তখন বাজারে দাম যাবে সর্বোচ্চ ১৫-২০ টাকা কেজি। জানালেন, আলু তুলে ভুট্টা লাগাবেন তিনি।
এক বিঘা জমিতে আলু চাষের খরচের হিসাবে আলমগীর জানান, জমি ভাড়া ৫ হাজার টাকা, চাষ বাবদ (পাঁচ চাষ) খরচ হয়েছে ৩ হাজার, সার (ড্যাপ, পটাশ, ইউরিয়া, ম্যাগনেশিয়াম) ৫ হাজার টাকা, বীজ ২১ হাজার টাকা, রোপণ খচর ৪ হাজার, সেচ ২ হাজার, কীটনাশক ৩ হাজার, দ্বিতীয় ধাপে সার (ইউরিয়া) ২ হাজার ৭০০, মাটি দেওয়া ২ হাজার, উত্তোলন বাবদ ৩ হাজার টাকাসহ মোট খরচ হয়েছে ৫০ হাজার ৭০০ টাকা। এক বিঘায় প্রাপ্ত ৫২ মণ আলু বিক্রি করেছেন ৮৭ হাজার ৩৬০ টাকায়। হিসাব অনুযায়ী এক বিঘায় তার লাভ হয়েছে ৩৬ হাজার ৬৬০ টাকা। যদি ৯০ দিন বয়সে আলু তুলতেন তাহলে সর্বোচ্চ ১০-১২ হাজার টাকা লাভ থাকত।
ভালো দাম পেয়ে অপরিণত অবস্থায় আলু তোলায় উৎপাদনে ঘাটতি হবে কিনা এমন প্রশ্নে কয়েকজন কৃষক বলেন, 'এই আলু হিমাগারে রাখার জন্য নয়। কৃষক আগাম চাষ করেছেন মূলত দামের আশায়। কারণ নভেম্বরের শুরু থেকে আগের আলুতে টান পড়তে শুরু করে। এ সময় হিমাগারেও তেমন একটা আলু থাকে না।'
একই কথা বলছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নুরুজ্জামান। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে বাজার বিবেচনায় কৃষক আগাম আলু চাষ করছেন। আমরাও তাদেরকে নিয়মিত আলু লাগানোর পাশাপাশি আগাম চাষে উদ্বুদ্ধ করছি। তবে এক্ষেত্রে জাতীয় উৎপাদন কিংবা সরবরাহে কোনো প্রভাব পড়বে না। গত অর্থ বছরের তুলনায় দেড় হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ বেশি হয়েছে। আবহাওয়া অনূকুলে থাকায় আলুর ভালো ফলনের আশা করছেন তিনি।