ঢাকায় সরকারের মেঘা প্রকল্পের জন্য বায়ুদূষণ হচ্ছে, এমন অভিযোগ ছিল দীর্ঘদিন। তবে গেল বছরের শেষে রাজধানীর মেঘা প্রকল্প মেট্রো রেল, এক্সপ্রেসওয়ে ও বিমান বন্দরের থার্ড টার্মিনালের কাজ সমাপ্ত হয়। তারপরও শুষ্ক মৌসুমের শুরু থেকে বায়ুদূষণে প্রায় দিনই বিশ্বে শীর্ষে থাকছে রাজধানী ঢাকা। গত দুই দশক ধরে বায়ুদূষণ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে ঢাকা।
মেঘা প্রকল্প সম্পন্ন হলেও রাজধানীতে বছর ধরেই ভবন ও রাস্তা নির্মাণ ও মেরামতের কাজ চলছে। ঢাকার আশপাশের ইটভাটাগুলো এখনো চলছে সনাতন পদ্ধতিতে। এসব ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কয়লা, কাঠ ব্যবহার করা হয়। ফলে এটা থেকে প্রচুর ছাই তৈরি হয় এবং কার্বন মনোঅক্সাইড, সালফার অক্সাইড ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো দূষিত কণা বাতাসের সঙ্গে মেশে। এছাড়াও ঢাকায় নানা ধরনের শিল্প কারখানার কারণে বায়ুদূষণে ৩০ শতাংশেরও বেশি ঘটে।
ঢাকা শহরে যে পরিমাণ বাস চলে, তার সত্তর শতাংশেরই আয়ুষ্কাল শেষ। লক্কড়-ঝক্কড় বাস চলছে প্রকাশ্যে। গণপরিবহণের পেট্রোল পোড়া বস্ন্যাক কার্বন দূষণের একটি উৎস হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এছাড়াও শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে বর্জ্য পোড়ানো হয়। ময়লার স্তূপ যেখানে থাকে, সেখানে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। সেই মিথেন গ্যাস বন্ধের জন্য পরিচ্ছন্ন কর্মীরা আগুন জ্বালান। এতে বায়ুদুষণ বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও শুষ্ক মৌসুমে উত্তরের হিমেল হাওয়া বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। এতে ভারতের দিলিস্নর বায়ুদূষণ মধ্যপ্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ হয়ে ঢাকার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এ কারণে দেশে ৬.৫ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়। এছাড়া রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণ কাজ থেকে ৩১ শতাংশ, ইটভাটা ও শিল্প কারখানা থেকে ৩১ শতাংশ, যানবাহন থেকে ১৫ শতাংশ, গৃহস্থালি বা রান্নার চুলার কাজের থেকে ৮.৫ শতাংশ এবং বর্জ্য পোড়ানো থেকে ৮ শতাংশ বায়ুদূষণ ঘটে। বিশ্বব্যাংক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণায় এমন তথ্য ওঠে এসেছে।
শুষ্ক মৌসুমের (অক্টোবরের শেষ থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত) শুরু থেকে ঢাকায় বায়ুদূষণ ভয়াবহ থাকে। বাতাসের গুণগতমান বছরের প্রায় অর্ধেক সময় ধরেই খুব খারাপ থাকে এবং শীতকালে তা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। সোমবার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণ এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) এর তথ্যে ২৪১ স্কোর নিয়ে দূষণে বিশ্বে প্রথম হয় পাকিস্তানের করাচি, ১৮৮ স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা। শীতে কুয়াশার দিনে ১৮৭ স্কোর নিয়ে চতুর্থ হয় ঢাকা।
একিউআই স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ হলে নগরবাসীর প্রত্যেকের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়তে পারে, বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। জনবহুল ঢাকা কয়েক বছর ধরেই দূষিত বাতাস নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। মূলত নির্মাণ কাজের নিয়ন্ত্রণহীন ধুলা, যানবাহনের ধোঁয়া, ইটভাটা প্রভৃতি কারণে রাজধানীতে দূষণের মাত্রা চরম বিপর্যয়ের মধ্যে।
এদিকে এক গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ুদূষণজনিত রোগে দেশে ৫ জনে ১ জনের মৃতু্য হচ্ছে। বায়ুদূষণের জন্য বাংলাদেশে অকালমৃতু্যর হার প্রায় ২০ শতাংশ। মানুষের মৃতু্যর ক্ষেত্রে চতুর্থ প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণে ঢাকায় প্রতি বছর ৮৮ হাজার মানুষের মৃতু্য হচ্ছে। অন্যদিকে ঢাকায় মানুষের গড় আয়ু কমছে ৭ বছর ৭ মাস। আর সারাদেশে গড় আয়ু কমেছে ৬ বছর ৮ মাস। বায়ুদূষণে জিডিপির ৫ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। বায়ুদূষণের কারণে মানুষের শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে ক্যানসার, অ্যাজমা, অ্যালার্জি, চুলকানিসহ বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বায়ুদূষণের কারণে শিশুদের আইকিউ কমে যাচ্ছে। ফলে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। দূষণের কারণে বাংলাদেশের বাতাসের গুণগত মান বছরের প্রায় অর্ধেক সময়েই অত্যন্ত দূষিতই থাকছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্টের পরিচালক মো. জিয়াউল হক বলেন, বাংলাদেশের বাতাসে বস্তুকণা ২.৫-এর পরিমাণ ৭৭.১ মাইক্রাগ্রাম পার কিউবিক মিটার, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদন্ডের চেয়ে সাত গুণ বেশি। দেশের ৬৪টি জেলার প্রত্যেকটিতেই বায়ুদূষণের হার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী তিন গুণ বেশি। শহরে বস্তুকণার মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী বলা হয়, অতিসূক্ষ বস্তুকণা ২ দশমিক ৫। যা মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ঢুকে যায়। শ্বাস নিঃশ্বাস রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীর ঢাকার ৭১ শতাংশ মানুষ বিষণ্নতায় ভুগছেন। আর ৬৮ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত। গবেষণায় অংশ নেওয়া রাজধানীবাসী যানজট, শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণকে শহরের সবচেয়ে প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দূষণের কারণে মানুষের মানসিক ও শারীরিক সমস্যা বাড়ছে। চিকিৎসা নিতে গিয়ে আর্থিক চাপে পড়ছে মানুষ। আয়ের বড় অংশ চলে যাচ্ছে চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে।
বাংলাদেশ নেচার কনজার্ভেশন ম্যানেজমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. এস. এম. মনজুরুল হান্নান খান বলেন, বায়ুদূষণজনিত ক্যানসারসহ শ্বাসযন্ত্রের নানা রোগ বাড়ছে। দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে মস্তিষ্কে অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি হয় এবং স্নায়ুগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। অনেকের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। ফুসফুসে ও হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বায়ুদূষণের কারণে মানুষের শরীরে নানা রোগবালাই যেমন বাসা বাঁধছে, তেমনি মনের মধ্যেও রোগশোকের জন্ম দিচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাড়ছে মানুষের বিষণ্নতা। বায়ুদূষণের কারণে মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। বেঁচে থাকার জন্য শ্বাস নিতে গিয়ে মানুষ প্রতিদিন ফুসফুসের মাধম্যে দুই হাজার লিটারের বেশি দূষিত বাতাস গ্রহণ করে থাকেন। এই শ্বাস গ্রহণের সময়েই ফুসফুসে ঢুকছে দূষিত বস্তুকণা। দূষিত বায়ুর এই বস্তুকণা মানুষের মৃতু্যকে ত্বরান্বিত করছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের বাতাসের গুণগত মান ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। সে অনুযায়ী, বাতাসের গুণগত মানের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান পাকিস্তান, আফগানিস্তানের চেয়ে ভালো। ভারতের দিলিস্নর চেয়ে ভালো হলেও কলকাতার তুলনায় খারাপ। এই অবনতির জন্য ধুলা, ধোঁয়ার পরিচিত উৎসের বাইরেও গৃহস্থালি রান্নার ধোঁয়াকে দায়ী করা হচ্ছে রিপোর্টে।
বিশ্বব্যাংক জানায়, দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ুদূষণ এবং জনস্বাস্থ্য প্রতিবেদন অনুযায়ী সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এবং দরিদ্র অঞ্চলে কিছু সূক্ষ্ণ কণা, যেমন- কাচ এবং ছোট ধূলিকণার ঘনত্ব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানের চেয়ে ২০ গুণ বেশি। এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতি বছর আনুমানিক ২ মিলিয়ন মানুষের অকালমৃতু্য ঘটে।
এদিকে, পরিসংখ্যান বু্যরোর সবশেষ খানা ও আয়-ব্যয় জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে বিশ্বব্যাংক বলছে, দেশে ৪ কোটি ১০ লাখ পরিবারের মধ্যে মাত্র ৭০ লাখ উন্নত চুলায় রান্না করে। এখনো কঠিন জ্বালানি ব্যবহার করছে ৭৪ শতাংশ পরিবার। ঢাকার বাতাসের মান বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত মানে আনতে, প্রতি মাইক্রোগ্রাম দূষণ কমাতে বিনিয়োগ করতে হবে প্রায় ১শ' কোটি টাকা।
এ বিষয়ে অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান বলেন, সারাদেশে ইটভাটা আছে প্রায় আট হাজার। আর ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোতে রয়েছে সাড়ে ১ হাজার ২০০ ইটভাটা। ইটভাটাগুলো প্রতি মৌসুমে ২৫ লাখ টন কয়লা ও ২২ লাখ টন জ্বালানি কাঠ পোড়ায়। ইটভাটার দূষণে ৮৮ লাখ ৮৬ হাজার টন গ্রিনহাউস গ্যাস হয়। এতে দূষণ বাড়ছে। এছাড়াও রাজধানী ঢাকার দূষণ রোধে দুই দফায় বিশ্বব্যাংক প্রায় আট হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। তারপরও মহানগরে দূষণ ঠেকাতে পারেনি পরিবেশ অধিদপ্তর।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্টের পরিচালক মো. জিয়াউল হক বলেন, বায়ুদূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করেছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর এর বড় প্রভাব রয়েছে। প্রতিবেশী দেশের দূষণসহ উন্নয়নকাজ, ইটভাটার দূষণ, একাধিকবার ফসল উৎপাদন, শিল্প কারখানার দূষণ ও সিমেন্ট কারখানার দূষণ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। সঠিক পদক্ষেপ এবং নীতির মাধ্যমে বায়ুদূষণ মোকাবিলা করা সম্ভব। এতে বেসরকারি উদ্যোগও প্রয়োজন। বায়ুদূষণ রোধে সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে।