বিলুপ্তির পথে কারওয়ান বাজার বস্তি

আগুনে গৃহহীনরা আশ্রয় নিচ্ছেন অন্য বস্তিতে, নানা কারণে কমছে ঢাকার বস্তির সংখ্যা

প্রকাশ | ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

গাফফার খান চৌধুরী
সর্বস্ব হারিয়ে ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে কারওয়ান বাজারের মোলস্নাবাড়ি বস্তিবাসী
বিলুপ্তির পথে বহু বছরের পুরনো কারওয়ান বাজারের মোলস্নাবাড়ি বস্তি। ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে বস্তিটির অন্তত তিনশ' ঘর পুড়ে গেছে। দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন দুই বছর বয়সি শিশুপুত্রসহ এক মা। মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয়ে শিশুপূত্রসহ আরেক মা চিকিৎসাধীন। আগুনে গৃহহীন হয়ে পড়েছেন অন্তত হাজারখানেক বস্তিবাসী। প্রচন্ড শীতে টিকতে না পেরে বস্তিটির গৃহহীন বাসিন্দারা আশ্রয় নিচ্ছেন ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে। বস্তিবাসীরা বলছেন, স্বল্পসময়ের মধ্যেই বস্তিটি খালি হয়ে যাবে। উঠে যাবে বস্তিটি। অগ্নিকান্ডসহ নানা কারণে ঢাকায় বস্তির সংখ্যা দিনকে দিনে কমছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। রোববার সরেজমিন বস্তিটির সার্বিক অবস্থা দেখতে গেলে কথা হয় সেখানকার বাসিন্দা ইসমাইল হোসেনের (৬৫) সঙ্গে। তিনি বলেন, বাড়ি জামালপুর জেলার সরিষাবাড়িতে। যমুনা নদীর তীব্র ভাঙনে বাড়িঘর বিলীন হয়ে যায়। এরপর আশ্রয় নেন বস্তিটিতে। তখন বয়স ২০ বছরের মতো। দেখতে দেখতে বস্তিতে কেটে গেছে ৪৫ বছর। ওই সময় বস্তিটিতে তেমন লোকজন ছিল না। পুরোএলাকা খালি ছিল। বাঁশ কাঠ দিয়ে ছোট ঘর তুলে বসবাস শুরু করেন। খালি জায়গায় শাক সবজিও চাষ করতেন। পরবর্তীতে বস্তির আকার বাড়তে থাকে। কারওয়ান বাজারে ট্রেনের ধাক্কায় চার জনের মৃতু্যর পর উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়। ছোট হতে থাকে বস্তির আকার। \হরেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কারওয়ান বাজার রেললাইনের উপরে বসা মাছ বাজারে ট্রেনের ধাক্কায় এক নারীসহ ৪ জনের মৃতু্য হয়। আহত হন ৯ জন। এরপর কমলাপুর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার এলাকায় রেলপথের দুই পাশের প্রায় ৫ হাজার অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। যদিও বেশি দিন তা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। স্থানীয় প্রভাবশালীদের মদদে আবার বস্তিসহ নানা ধরনের অবৈধ স্থাপনা গড়ে ওঠে। এ কারণে বস্তিতে মাদক, জুয়া, অসামাজিক কর্মকান্ড, চুরি, ডাকাতি, অপরাধীদের আশ্রয়স্থল হওয়ায় সেখানে কাঁচা টাকা উড়ে। গত শুক্রবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে কারওয়ান বাজার মোলস্নাবাড়ি বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিট ভোর ৬টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। আগুনে বস্তিটির পাঁচশ' ঘরের মধ্যে ৩শ' ঘর পুড়ে যায়। গৃহহীন হয়ে পড়ে অন্তত হাজারখানেক বস্তিবাসী। আগুনে জীবন্ত পুড়ে মারা যান দুই বছরের শিশু নাফি ইসলাম ও তার মা শারমিন বেগম (২২)। দগ্ধ হয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড পস্নাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন চার বছর বয়সি শিশুপুত্র নজরুল ইসলাম ও তার মা নাজমা বেগম (২৫)। তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকরা জানান। বস্তির বাসিন্দারা আগুন লাগার পর ঘর থেকে বের হওয়ার সময় সঙ্গে থাকা যা কিছু আর মোবাইল ফোন ছাড়া কিছুই নিতে পারেননি। গৃহহীনদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। মেয়র ক্ষতিগ্রস্ত প্রতি পরিবারকে ৫ হাজার, প্রয়োজনে ১০ হাজার টাকা করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। কিছু কিছু পরিবার আর্থিক সহায়তা পেয়েছে। বাকিরা পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। অগ্নিকান্ডের কারণ উদঘাটন করতে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি। সরেজমিন দেখা গেছে, বস্তির বাসিন্দারা পুড়ে যাওয়া জিনিসপত্র ভাঙারীর দোকানে বিক্রি করে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। তাদের অনেকের সঙ্গেই কথা হয়। মফিজ বলছিলেন, যে সামান্য শীতবস্ত্র পাওয়া গেছে, তা দিয়ে প্রচন্ড শীত পার করা সম্ভব না। এছাড়া শীতের কারণে খোলা জায়গায় টেকা যাচ্ছে না। তাই ঢাকার বিভিন্ন বস্তিতে আশ্রয় নিচ্ছেন গৃহহীনদের। যাদের মধ্যে অন্তত শতকরা ৮০ ভাগ আপাতত আশ্রয় নিয়েছেন কমলাপুর রেলওয়ে বস্তিতে। বাকিদের অনেকেই ভাসানটেক বস্তি, কমলাপুরের টিটিপাড়া বস্তি, তেজগাঁও বেগুনবাড়ি বস্তি, তেজগাঁও রেলস্টেশন সংলগ্ন বাজার বস্তিসহ বিভিন্ন বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছেন। মূলত বস্তির বাসিন্দাদের সঙ্গে অন্যান্য বস্তিতে থাকা বাসিন্দাদের যোগাযোগ রয়েছে। এছাড়া অনেক আত্মীয়-স্বজনও রয়েছেন অন্যান্য বস্তিতে। আপাতত অনেকেই ঘর ভাড়া নিয়ে সেই বস্তিতে উঠেছেন। অনেকেই আবার সাময়িকভাবে অন্যান্য বস্তিতে থাকা আত্মীয় স্বজনের কাছে আশ্রয় নিয়েছেন। বস্তির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এফডিসির (বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা) পেছনে এবং তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ডের কাছাকাছি অবস্থিত বস্তিটি আকারে ছোট। আগে অনেক বড় থাকলেও এলাকাটিতে সড়ক বিভাগের উন্নয়ন কাজ চলছে। উন্নয়ন কাজের মালামালের চুরি ঠেকাতে স্টিলের বার দিয়ে ভারি পেস্নন শিট দিয়ে বস্তিটি একপ্রকার ঘেরাও করে ফেলা হয়েছে। মাঝে মাঝে বস্তিতে ঢোকার ছোট পকেট গেট রাখা হয়েছে। এজন্য চলাচলের ব্যাপক অসুবিধা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই আরও আগেই বস্তিটি ছেড়ে চলে গেছেন। সবশেষ আগুন লাগার পর বস্তিটিতে এখন কোনোমতে প্রায় দুইশ' বস্তিঘর টিকে আছে। স্বল্পসময়ের মধ্যেও তারা চলে যেতে বাধ্য হবেন। এ কারণে চারদিকে যেভাবে মালামাল ফেলা হয়েছে, যাতায়াতের কোনো রাস্তা নেই। বাধ্য হয়েই বস্তিবাসীদের এলাকা ছাড়তে হচ্ছে। মূলত বস্তিটি একপ্রকার বিলুপ্তির পথে রয়েছে। হয়তো স্বল্পসময়ের মধ্যেই বস্তিটি খালি হয়ে যাবে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বস্তি উন্নয়ন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আধুনিক যুগেও খোদ রাজধানীতে বস্তি থাকার বিষয়টি বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। এজন্য সরকার গৃহহীনদের ঘরের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। যাতে করে অপরাধ কমে আসার পাশাপাশি গৃহহীন মানুষের সংখ্যা কমে আসে। সারাদেশে প্রায় ১৫ হাজার একর জায়গার উপর রয়েছে ছোট-বড় ৪৫ হাজার বস্তি। ঢাকায় বস্তির সংখ্যা ছিল ১১০টি। গত ১০ বছরে ঢাকা থেকে প্রায় ১১টি বস্তি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বস্তির অনেক বাসিন্দা সরকারি ঘর পেয়ে গ্রামে চলে গেছেন। আবার অনেকের ছেলেমেয়ে মোটামুটি ভালো চাকরি করায় তারাও বস্তি ছেড়েছেন। বাস্তুহারা উন্নয়ন কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান হাজী মমিন খান (৭০) জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নদীভাঙ্গা এলাকার গৃহহীন মানুষদের অনেকেই ট্রাকে ট্রাকে ঢাকায় এসে আশ্রয় নেন মিরপুর, কালশী, বাউনিয়াসহ সরকারি ফাঁকা জায়গায়। এভাবেই ঢাকায় বস্তি গড়ে ওঠে। বস্তির বাসিন্দাদের শতকরা ৮৫ ভাগই নদী ভাঙ্গন এলাকার গৃহহীন মানুষ। মানুষের ঢাকামুখী হওয়াকে বাধা দেয়নি বঙ্গবন্ধু সরকার। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বস্তি উন্নয়ন কর্মকান্ডে জড়িত ইউপিপিআর (আরবান পার্টনারশিপস ফর পোভার্টি রিডাসন প্রজেক্ট) এর তথ্য মতে, দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা এক সময় প্রায় ৩ কোটি ছিল। আর হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ২৭ লাখ। বর্তমানে তা কমছে। হতদরিদ্র লোকজনই বস্তিতে বসবাস করছেন। তবে অনেকেই আবার সুবিধার জন্য এবং বস্তি থেকে টাকা রোজগারের জন্য বস্তিতে বসবাস করেন। তারা প্রকৃত অর্থে বস্তিবাসী না। রেলওয়ের সাড়ে ৪ হাজার একরের বেশি জায়গায় রয়েছে বস্তি। যার মধ্যে শুধু ঢাকা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার রেলপথের দুই ধারেই প্রায় ৫৮ একর জমি বেদখল করে গড়ে তোলা হয়েছে বস্তি। মোলস্না বাড়ি বস্তিটি তারই একটি। ঢাকা সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে, ঢাকায় মোট ১১০টি বস্তি ছিল। বিগত সময়ে ১০টি বস্তি উঠে গেছে। মোলস্নাবাড়ি বস্তির বাসিন্দারা চলে গেলে রাজধানীতে বস্তির সংখ্যা দাঁড়াবে ৯৯টিতে। ঢাকার বস্তিতে বসবাসকারীর সংখ্যা প্রায় ২ লাখ। বস্তিতে বসবাসকারীদের মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগই স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি। তারাই নিয়ন্ত্রণ করে বস্তি। কারণ বস্তিতে কাঁচা টাকা উড়ে। প্রসঙ্গত, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক সরকার পুনর্বাসন না করা পর্যন্ত বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ করতে পারবে না। আদালতে বস্তিবাসীদের পক্ষে রিট আবেদন করেছেন বিশিষ্ট আইনজীবী ও বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতা ডক্টর কামাল হোসেন। বস্তিবাসীদের পক্ষে বর্তমানে লড়ে যাচ্ছেন তাঁরই মেয়ে ব্যারিস্টার সারা হোসেন। অদ্যাবধি উচ্চ আদালতের এমন নির্দেশনা বহাল আছে।