বিজয় মিছিলে বোমা হামলায় আহত সেই দোকানির মৃতু্য

নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা ঢাকার ধামরাই, সাভার ও নাটোরের বড়াইগ্রামে হামলা সংঘর্ষে অন্তত ৩৪ জন আহত

প্রকাশ | ১২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
মাদারীপুরের কালকিনিতে সদ্য বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিজয় মিছিলে বোমা হামলায় আহত সেই চা দোকানি এমরাত মারা গেছেন। তিন দিন মৃতু্যর সঙ্গে লড়ে বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তার মৃতু্য হয়। অন্যদিকে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় আরও ৩৪ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার ধামরাইয়ে ২৫, সাভারে ৯ ও নাটোরের বড়াইগ্রামে ৯ জন রয়েছেন। বুধবার সকাল থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত এসব ঘটনা ঘটে। কালকিনি (মাদারীপুর) প্রতিনিধি জানান, বিজয় মিছিলে বোমা হামলায় আহত চা দোকানি এমরাত সরদার তিন দিন মৃতু্যর সঙ্গে লড়ে অবশেষে মারা গেছেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। এমরাত উপজেলার কালীনগর গ্রামের ফরজউদ্দিন সরদারের ছেলে। মাদারীপুরের কালকিনির এই ঘটনার বিচার দাবি করেছেন সদ্য বিজয়ী মাদারীপুর-০৩ আসনের সংসদ সদস্য ও নিহতের স্বজনরা। অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে এড়াতে এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ। স্থানীয়ার জানায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাদারীপুর-৩ আসনে নৌকার প্রার্থী ড. আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপকে পরাজিত করে বিজয়ী হন স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমিনা বেগম। গত সোমবার সকালে তাহমিনার সমর্থকরা একটি বিজয় মিছিল বের করেন। মিছিলটি কালীগঞ্জ থেকে ফাঁসিয়াতলা বাজারের যাওয়ার পথে মিছিলে অতর্কিত হামলা চালায় প্রতিপক্ষ। এ সময় বেশ কয়েকটি বোমা নিক্ষেপ করার অভিযোগ ওঠে। এতে আহত হন অন্তত ১০ জন। তাদের উদ্ধার করে ভর্তি করা হয় মাদারীপুর জেলা সদর হাসপাতালে। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় দু'জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে। পরে সেখান থেকে বৃহস্পতিবার ভোরে আহত এমারত সরদারকে ভর্তি করা হয় রাজধানীর প্রাইম জেনারেল হাসপাতালে। তিন দিন মৃতু্যর সঙ্গে লড়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এমরাত। এ ঘটনায় নিহত এমারতের ছেলে হাসান সরদার বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে কালকিনি থানায় ২০ জনের নামে একটি মামলা করেন। এই ঘটনার বিচার দাবি করেছেন স্বজন ও সদ্য বিজয়ী সংসদ সদস্য তাহমিনা বেগম। ড. আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপের সমর্থক ও আলীনগর ইউনিয়নের চেয়াম্যান সাহিদ পারভেজ বলেন, একটি পক্ষ এই বোমা হামলার ঘটনার দোষ আমাদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছে। অথচ আমি বা আমাদের কোনো লোক এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নই। বিজয় মিছিলে নিজেরাই আনন্দ করার জন্য ককটেল ফাটাতে ফাটাতে এসেছে। পরে নিজেদের ফাটানো ককটেলেই এই দুর্ঘটনা ঘটে। আমিও চাই পুলিশ প্রশাসন এর সঠিক তদন্ত করে দোষীদের বিচার করুক। রাজধানী ঢাকার প্রাইম জেনারেল হাসপাতালের সিইও ডা. গোলাম মোস্তফা জানান, এমরাতের শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত হয়ে যায়। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করার আগেই অবস্থা খারাপ ছিল। ভোরে ভর্তি করলে দুপুর ২টার দিকে তিনি মারা গেছেন। মাদারীপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য তাহমিনা বেগম বলেন, মিছিলে বোমা হামলা এটি গুরুতর অপরাধ। ড. আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপের লোকজন এর সঙ্গে জড়িত। এই ঘটনার বিচার হওয়া উচিত। মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. কামরুল ইসলাম জানান, বোমা হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে। আসামিদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ধামরাই (ঢাকা) প্রতিনিধি জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকার ধামরাইয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী ট্রাক প্রতীকের সমর্থক ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফের দু'টি ইটভাটায় দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, শ্রমিকদের মারধর ও চার লাখ টাকা লুট করে নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে ২৫ জন শ্রমিক আহত হয়েছে। বুধবার সকালে এ ঘটনার পর তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। হামলাকারীদের হুমকিতে ৩০ জন শ্রমিক ভাটা ছেড়ে চলে গেছেন বলে জানান ভাটার মালিক। এ ঘটনায় এলাকায় চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। দফায় দফায় ধামরাই থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে যাচ্ছে। ঘটনাটি ঘটেছে সোমভাগ ইউনিয়নের গোয়ালদী ও ডাউটিয়া এলাকায়। বুধবার রাতে এ ঘটনায় ধামরাই থানায় মামলা হয়েছে। জানা গেছে, ধামরাইয়ের সোমভাগ ইউনিয়নের গোয়ালদী গ্রামের ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের স্বতন্ত্র ট্রাক মার্কার প্রার্থী সাবেক এমপি এম এ মালেকের সক্রিয় সমর্থক ছিলেন। এতে ক্ষিপ্ত হন প্রতিপক্ষরা। এ ঘটনার জের ধরে তার মালিকানাধীন ডাউটিয়া এলাকায় সান ব্রিকস ও গোয়ালদী এলাকায় লামিয়া ব্রিকসে ২৫ থেকে ৩০টি মোটর সাইকেলে করে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ জন দুর্বৃত্ত হামলা চালায়। এ সময় দু'টি ভাটার শ্রমিকদের মারধর ও ইটভাটার মেশিন, অফিস কক্ষ ভাঙচুর ও টেবিলের ড্রয়ার ভেঙে ৪ লাখ ১৬ হাজার টাকা লুটে নিয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। এ সময় হামলাকারীরা ইটভাটা বন্ধ রেখে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দেয়। ইটভাটার শ্রমিক খোরশেদ আলম, মহসিন, ইকবাল হোসেন, সাইদুর রহমান ও জোবায়ের হোসেন জানান, মোটর সাইকেলে করে ৪০ থেকে ৫০ জন লোক এসেই আকস্মিকভাবে আমাদের মারধর শুরু করে। এরপর তারা ইটভাটা বন্ধ রাখতে বলে মেশিন বন্ধ করে দেয়। তাদের মারধরে প্রায় ২৫ জন শ্রমিক আহত হন। ইটভাটার ম্যানেজার হজরত আলী বলেন, অফিস কক্ষের দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে টেবিলের ড্রয়ার ভেঙে ৪ লাখ ১৬ হাজার লুটে নিয়েছে হামলাকারীরা। ইটভাটার মালিক আব্দুল লতিফ জানান, নির্বাচনে পক্ষ নেওয়াকে কেন্দ্র করেই এমন নগ্ন হামলা হয়েছে। এতে আমার প্রায় ৩০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ধামরাই থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) নির্মল কুমার দাস জানান, হামলার খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। নির্বাচনী পরবর্তী সহিংসতা রোধে আমরা মাঠে আছি। যেই সহিংসতা করবে তাকে ছাড় দেওয়া হবে না। আর ইটভাটার হামলার ঘটনার তদন্ত হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, পরিস্থিতি এখন শান্ত আছে। নির্বাচনী সহিংসতা সাভারে নৌকা-ঈগলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে আহত ৭ এদিকে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় ঢাকার অদূরে সাভারে পরাজিত আওয়ামী লীগের মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর সমর্থক ও ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। বুধবার রাতে পৌরসভার কাতলাপুর এলাকার এ ঘটনায় উভয় পক্ষের অন্তত সাতজন আহত হয়েছেন। আহতরা হলেন সাগর, পান্না, সাব্বির, জাহিদ, হৃদয়, লাদেন ও সম্পদ। এর মধ্যে সাগর ও সম্পদের মাথায় সেলাই দিতে হয়েছে। পান্নার আঘাত গুরুতর হওয়ায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বাকিদের সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, রাত ৯টার দিকে সাভারের কাতলাপুরে সাভার পৌর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবদুল হালিমের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে তিনিসহ বেশ কয়েকজন বসেছিলেন। আবদুল হালিম নির্বাচনের সময় ঈগল প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী তালুকদার মো. তৌহিদ জং ওরফে মুরাদের পক্ষে কাজ করেছেন। নৌকার সমর্থকদের সঙ্গে আগের একটি বিরোধ মীমাংসার জন্য সেখানে দুই পক্ষের বৈঠকের কথা ছিল। সেখানে নৌকার ১৫ থেকে ২০ জন সমর্থক পৌঁছালে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে সাভার মডেল থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। নৌকার সমর্থক সাভার পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফরহাদ হোসেন বলেন, ভোটের ফলাফলে ঈগলের প্রার্থী তাদের কেন্দ্রে কিছু ভোট বেশি পান। পরে তারা নৌকার সমর্থকদের মারধর করেন। ওই ঘটনায় রাতে মীমাংসার জন্য বসার কথা ছিল। আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসার জন্য তারা ৮ থেকে ১০ জনসহ আবদুল হালিমের ওইখানে গেলে তার ছেলে রবিউল আওয়াল তাদের মারধর করেন। সাভার মডেল থানার পরিদর্শক (অপারেশন) নয়ন কারকুন বলেন, এ ঘটনায় রাতে আবদুল হালিমকে আটক করা হয়েছে। এ ছাড়া জিজ্ঞাসাবাদের জন্য উভয় পক্ষের বেশ কয়েকজনকে থানায় আনা হয়েছে। দুই পক্ষের লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে। তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নাটোর প্রতিনিধি জানান, জেলার বড়াইগ্রামে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় দু'জন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার দিকে চান্দাই ইউনিয়নের দিয়াড়গাড়ফা সরদারপাড়া মোমিনের চায়ের দোকানের সামনে ও বুধবার রাত ৯টার দিকে জোনাইল ইউনিয়নের রানীরবাজারে এ ঘটনা ঘটে। আহতদের উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে ভর্তি করা হয়েছে। আহতরা হলেন উপজেলার চান্দাই ইউনিয়নের দিয়াড়গাড়ফা উত্তরপারা গ্রামের মৃত নওশের প্রামাণিকের ছেলে আব্দুল খালেক (৬০) ও জোনাইল ইউনিয়নের দাড়িকুশি পুরানপাড়া গ্রামের মৃত আবুল হোসেন মোলস্নার ছেলে নওশের আলী মোলস্না (৫৫)। তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ট্রাক প্রতীকের নির্বাচনী প্রচার প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। আহত আব্দুল খালেক বলেন, আমি নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক আসিফ আব্দুলস্নাহ বিন কুদ্দুস শোভনের ট্রাক প্রতীকের নির্বাচনী প্রচারণা করেছিলাম। নির্বাচনের আগের দিন দিয়াড়গাড়ফা গ্রামের মৃত শেরা মোলস্নার ছেলে ও নৌকা প্রতীকের কর্মী আরব আলীসহ কয়েকজন আমাকে প্রচারণায় অংশগ্রহণ করতে নিষেধ করে। আমি না শুনলে আমাকে নির্বাচনের পরে মারধরের হুমকি দেয়। তিনি আরও বলেন, আমি সকালে দিয়াড়গাড়ফা সরদারপাড়া মোমিনের চায়ের দোকানে বসেছিলাম। হঠাৎ করে আরব আলীসহ (৫৫) কয়েকজন এসে আমাকে মারধর শুরু করে। পরে স্থানীয়রা এগিয়ে এসে আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন। নওশের আলী মোলস্না বলেন, আমি ট্রাকের কর্মী ছিলাম। বুধবার ৯টার দিকে দাড়িকুশি গ্রামের সাকাত আলীর ছেলে ও নৌকা প্রতীকের কর্মী জালাল হোসেন (৫৫) ও পেস্ন আলী (২৩) আমার কাছে এসে এক লক্ষ টাকা চাঁদা দাবি করে। তারা বলে 'তুই ট্রাকের নির্বাচন করেছিস এখন তোকে এক লাখ টাকা দিতে হবে।' আমি টাকা দিতে অস্বীকার করলে তারা আমাকে মারধর করে। পরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। আরব আলী বলেন, আব্দুল খালেকের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক দ্বন্দ্ব আছে। তাকে মারধর করার মতো ঘটনাই ঘটেনি। আমাদের ওপর মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে। জালাল উদ্দিন বলেন, আমি পাওনা টাকা চাওয়ায় কথা কাটাকাটি হয়েছে। তার সঙ্গে মারধরের ঘটনা ঘটেনি। টাকা না দেওয়ার জন্য কৌশল করে চাঁদা দাবির অভিযোগ করছে। বড়াইগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. ডলী রানি বলেন, আহত দু'জনকে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। বড়াইগ্রাম থানার ওসি শফিউল আজম বলেন, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। লিখিত অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।