সর্বনিম্ন কিশোরগঞ্জে ১০.৩ ডিগ্রি
প্রচন্ড ঠান্ডায় কাহিল উত্তরের জনজীবন
প্রকাশ | ১২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
দেশের উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ফের হ্রাস পেতে শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার সকালে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে কিশোরগঞ্জের নিকলিতে। এদিকে বুধবারের চেয়ে দশমিক পাঁচ ডিগ্রি বেড়ে বৃহস্পতিবার সকালে ১০.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে নওগাঁর বদলগাছীতে। একই সময়ে কুড়িগ্রামে ১১.৫ ডিগ্রি, পঞ্চগড়ে ১২.২ ডিগ্রি ও ঠাকুরগাঁওয়ে ১১.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে আবহাওয়া বিভাগ। আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, পৌষের শেষে মৃদু শৈত্যপ্রবাহের এ ধারা অব্যাহত থাকতে পারে আরও কয়েকদিন। একইসঙ্গে আরও ঘনীভূত হতে পারে কুয়াশা। এছাড়া আগামী সপ্তাহে হালকা বৃষ্টি হতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাস তুলে ধরে আবহাওয়াবিদ মো. মনোয়ার হোসেন বলেন, অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে এবং এটি কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। কুয়াশার কারণে বিমান চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ এবং সড়ক যোগাযোগে সাময়িক বিঘ্ন ঘটতে পারে।
সারাদেশের মতো রাজধানীতেও জেঁকে বসেছে কনকনে শীত। প্রতিদিন হ্রাস পাচ্ছে তাপমাত্রা। রাজধানীতে এক দিনেই তাপমাত্রা কমেছে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। হিমেল হাওয়া আর ঘন কুয়াশায় বেড়েছে মানুষের ভোগান্তি। ঠান্ডায় কষ্ট পাচ্ছে ছিন্নমূল মানুষ। আবহাওয়াবিদরা জানান, পৌষের শেষে যেমন শীত অনুভূত হচ্ছে, মাঘের শুরুতেও তা থাকতে পারে। ঘন কুয়াশাও থাকবে সপ্তাহ জুড়ে। শক্তিশালী পশ্চিমা লঘুচাপের প্রভাবে ১৮ থেকে ২০ জানুয়ারি দেশব্যাপী বৃষ্টিপাতের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
আবহাওয়া পর্যবেক্ষক হামিদুল হক বলেন, 'ঘন কুয়াশার সঙ্গে উত্তরের হিমেল বাতাস প্রবাহিত হওয়ায় কয়েক দিন ধরেই তাপমাত্রা নিম্নমুখী হতে শুরু করে। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ব্যবধান কমে যাওয়ায় তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে।'
আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ থেকে প্রাপ্ত চিত্র বিশ্লেষণ করে বলেন, 'দেশব্যাপী চলমান কুয়াশার বিস্তার থাকবে সপ্তাহ জুড়ে। শনিবার পর্যন্ত উত্তর-পূর্ব দিকের বিভাগগুলোর ওপরে কুয়াশা বৃদ্ধি পেতে থাকার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। তবে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের বিভাগগুলোর ওপরে কুয়াশা কমতে থাকবে। সপ্তাহের শেষের দিকে আবারও রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের কোনো কোনো জেলার ওপরে সকাল ৬টার সময় তাপমাত্রা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।'
তিনি বলেন, 'শক্তিশালী পশ্চিমা লঘুচাপের প্রভাবে ১৮ থেকে ২০ জানুয়ারি দেশব্যাপী উলেস্নখযোগ্য পরিমাণে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। বৃষ্টির পরেই পুরোদেশে ভারী কুয়াশার বিস্তার লাভ করবে। এজন্য ১৫ জানুয়ারির পর আলু চাষিদের কৃত্রিম সেচ না দেওয়া উত্তম। এতে বৃষ্টির পানি জমে যাওয়ার সম্ভাবনা কমবে।'
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, ঘন কুয়াশা আর উত্তরের হিমেল বাতাসে কনকনে ঠান্ডায় কাবু হয়ে পড়েছে জেলার মানুষজন। তিন দিন ধরে সূর্যের দেখা মিলছে না জেলার কোথাও। এতে ঠান্ডা বেশি অনুভূত হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার সকালে জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দিনের তাপমাত্রা কমে রাতের তাপমাত্রার কাছাকাছি হওয়ায় দুপুর পর্যন্ত ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে। কনকনে ঠান্ডা উপেক্ষা করে দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষজন কাজে বের হলেও প্রয়োজনীয় গরম কাপড়ের অভাবে কষ্টে রয়েছে তারা। উত্তরের হিমেল হাওয়ায় শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কাহিল হয়েছে পড়েছেন নদ-নদী তীরবর্তী চর ও দ্বীপ চরের মানুষগুলো। কনকনে ঠান্ডায় কাজে বের হতে না পারায় কষ্টে পড়েছেন শ্রমজীবীরা। অন্যদিকে স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে বেড়েছে ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।
সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের পোড়ার চরের জহুরুল ইসলাম বলেন, 'আমাদের চরে কয়েকদিন থেকে খুব ঠান্ডা। ঘর থেকে বাহির হওয়া যাচ্ছে না। কারণ নদীর পাড়ে সবসময় বাতাস থাকে। বাতাসের কারণে ঠান্ডা বেশি।'
কুড়িগ্রাম সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল গফুর বলেন, 'আমার ইউনিয়নটি নদী বেষ্টিত। এখানে অনেক বেশি ঠান্ডা অনুভূত হয়। নির্বাচনের আগে সরকারিভাবে মাদ্রাসার বাচ্চাদের জন্য চারশ' কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। বুধবার মাত্র ৮০টি কম্বল বিভিন্ন এলাকায় বিতরণ করা হয়। এ অবস্থায় সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এগিয়ে এলে চরের মানুষ উপকৃত হতো।'
কুড়িগ্রামের রাজারহাট কৃষি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার বলেন, 'তাপমাত্রা আরও দুই-একদিন এমন থাকবে। পরে একটু উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়াও এ মাসে আরও একটি শৈত্যপ্রবাহ এ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যেতে পারে।'
এদিকে গত কয়েক দিন ধরেই ঘন কুয়াশার সঙ্গে উত্তরের হিমেল হাওয়া প্রবাহিত হওয়ায় নওগাঁর তাপমাত্রা নিম্নমুখী হতে শুরু করেছে। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ব্যবধান কমে যাওয়ায় তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে। তাপমাত্রা আগামীতে আরও কমার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। শীতের তীব্রতা জেঁকে বসায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ। পাশাপাশি গবাদিপশুগুলোও শীতে কাবু হয়ে পড়েছে। এগুলোর শীতের গরম কাপড় পরিয়ে দিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ছাড়া ঘন কুয়াশার কারণে রাস্তায় বিভিন্ন যানবাহন আলো জ্বালিয়ে চলাচল করছে।
পঞ্চগড় প্রতিনিধি জানান, গত চারদিন ধরে জেলার কোথাও সূর্যের দেখা নেই। একদিকে পৌষের হাড় কাঁপানো শীত। অন্যদিকে পেটের ক্ষুধায় যন্ত্রণা পোহাচ্ছে উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের নিম্ন আয়ের মানুষ।
বৃহস্পতিবার সকালে জেলায় ১২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। জেলার প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাসেল শাহ জানান. বুধবার (১০ জানুয়ারি) ১২ ডিগ্রি, মঙ্গলবার (৯ জানুয়ারি) ১১ দশমিক ৬, সোমবার (৮ জানুয়ারি) ১৩ দশমিক ৮, রোববার (৭ জানুয়ারি) ৮ দশমিক ১, শনিবার (৬ জানুয়ারি) ৯ দশমিক ৭, শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) ৮ দশমিক ৪, বৃহস্পতিবার (৪ জানুয়ারি) ৮ দশমিক ৫, বুধবার (৩ জানুয়ারি) ৭ দশমিক ৪, মঙ্গলবার (২ জানুয়ারি) ১০ দশমিক ৭ ও সোমবার (১ জানুয়ারি) ১১ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে জেলায়।
হিমশীতলের ঠান্ডায় বিপাকে পড়েছেন জেলার নিম্নআয়ের পেশাজীবী মানুষ। পাথর-চা শ্রমিক, দিনমজুর, থেকে নানান শ্রমজীবী মানুষ। কমে গেছে তাদের দৈনন্দিন রোজগার। পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিনযাপন করছেন তারা। প্রয়োজন ছাড়াও অনেকে ঘর থেকে বের না হলেও জীবিকার তাগিদে শীত উপেক্ষা করেই কাজে বেরিয়েছেন নিম্ন আয়ের পেশাজীবীরা। বিপাকে পড়েছেন চাষিরাও।
দিনের তাপমাত্রা নিম্নমুখী হওয়া ও সন্ধ্যার পর ফের ঠান্ডা বাতাস প্রবাহিত হওয়ায় কোলাহলহীন হয়ে পড়ে শহর ও গ্রামেরও হাটবাজারগুলো। বাজারগুলোতে কাগজ ও টায়ারে আগুন ধরিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা চালাচ্ছেন মানুষ।
ঠাকুরগাঁও? প্রতিনিধি জানান, হাড় কাঁপানো শীতে দুর্ভোগ বেড়েছে ছিন্নমূল মানুষের। টানা চারদিন ধরে তীব্র ঠান্ডায় নাকাল হয়ে পড়েছেন নিম্নবিত্ত ও অসহায় পরিবারগুলো। গরম কাপড়ের অভাবে কষ্টে দিন কাটছে তাদের। অনেক ব্যক্তি বা সংগঠনের উদ্যোগে শীতবস্ত্র বিতরণ করলেও তা পর্যাপ্ত নয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, গত তিনদিন ধরে ঠাকুরগাঁওয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ চলছে। বৃহস্পতিবার সকাল ৭টায় জেলায় সর্বনিম্ন ১১.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এ সময় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৯৮ শতাংশ।
সদর উপজেলার প?শ্চিম বেগুনবাড়ী ধামপাড়া এলাকার খিরপ্রসাদ, স?নেকা বালা, স্মৃতি রায়, ন?রেন রায়, বিরতা রায়, নু?নিবালাসহ একা?ধিক শীতার্ত ব্যক্তি ব?লেন, 'প্রতিবারই শু?নি সরকার কম্বল দেছে কত জায়গাত। কিন্তু হামরা একটাও পাইনি কোনোবার।'
ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ ম?তিলাল বর্মণ বলেন, 'দিনে থাকা গে?লেও রাইতে জারে (প্রচন্ড শীত) ঘুমে আই?সে না। সরকার গরিব মাই?নসেক (মানুষকে) কম্বল দেয় শুনেছু, কোনো সময় একখানও পাইনি। শীতে তো গ্রামের লোকেরই কষ্ট বেশি।'
অ?টোচালক জা?হেদুল ইসলাম বলেন, 'শীতের জন্য রাস্তায় বেশিক্ষণ থাকা যাচ্ছে না। আর রাস্তায় মানু?ষের চলাফেরাও কমে গে?ছে। এ কারণে রোজগার একেবারেই কমে গেছে।'
সদর উপজেলার বিলপাড়া গ্রামের কৃষক ন?গেন পাল ব?লেন, 'ঠান্ডার কারণে ফসলের খেতে কাজ করতে না পারায় কৃষিকাজ ব্যাহত হচ্ছে। ঠান্ডা উপেক্ষা করে মাঠে কাজ শুরু করলেও বেশিক্ষণ ক্ষেতে থাকা যাচ্ছে না। কনকনে ঠান্ডায় হাত-পা ও শরীর অবশ হ?য়ে আস?ছে।'
ঠাকুরগাঁও হাসপাতা?লের আবা?সিক চি?কিৎসা কর্মকর্তা র?কিবুল আলম ব?লেন, 'কয়েক দিন ধরে ঠান্ডাজনিত রোগী হাসপাতালে বেশি আসছে। শীতজ?নিত রোগী বে?শিরভাগ শিশু ও বৃদ্ধ র?য়ে?ছে। আমরা তাদেরকে সেবা দিয়ে যাচ্ছি।'
ঠাকুরগাঁও ত্রাণ শাখার অ?ফিস সহকা?রী ত?সিরুল ইসলাম বলেন, 'জেলার ৫?টি উপ?জেলায় ৩২ হাজার ৫শ' কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।'
আড়াইহাজার (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, গত তিন দিন ধরে সূর্যের দেখা মিলছে না। শৈত্যপ্রবাহের কারণে শীতে জবুথবু এলাকাবাসী। তিনদিন পর বৃহস্পতিবার সকালে সূর্যের দেখা মিললেও বিরাজ করছিল ঘন কুয়াশার কারণে। সূর্য ছিল নিরুত্তাপ বলের মতো। শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে যানবাহনগুলো হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করেছে।
বাজিতপুর (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, জেলার বাজিতপুর, কুলিয়ারচর, নিকলীসহ হাওড়ের বিভিন্ন উপজেলায় গত কয়েক দিন ধরে শৈত্যপ্রবাহের কারণে কনকনে ঠান্ডায় শিশু ও বৃদ্ধরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। ঘন কুয়াশার কারণে হাওড়ের নদী পথে ট্রলার, জাহাজ, ফেরি পারাপার বিঘ্নিত হচ্ছে। হাসপাতালে বাড়ছে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা। কর্মজীবী মানুষ কাজে যেতে পারছেন না। ফলে নিম্ন আয়ের ও খেটে খাওয়া মানুষগুলো অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।