ট্রেনে আগুন :অন্যের নামে টিকিট কিনেছিল জড়িতরা
তাদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে নিহতদের পরিবারের ক্ষোভ
প্রকাশ | ১১ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
গাফফার খান চৌধুরী
ঢাকা বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে অন্যের জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) কেনা টিকিট দিয়ে যাত্রীবেশে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস নামের ট্রেনে উঠেছিল একাধিক ব্যক্তি। তারাই ট্রেনটি তেজগাঁও রেলস্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছলে সুযোগ বুঝে আগুন দেয়। আগুন ছড়িয়ে পড়লে হুড়োহুড়ির মধ্যে সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গে ভিড়ের মধ্যে মিশে ট্রেন থেকে নেমে পালিয়ে যায়। বেনামে কেনা বেশ কয়েকটি টিকিটধারীদের বিষয়ে প্রাথমিক তথ্য জানতে পেরে তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এদিকে হতাহতদের পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর মঙ্গলবার রাত ১২টার পর নেত্রকোনা থেকে ঢাকার কমলাপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি। ভোর ৪টার দিকে ট্রেনটি ঢাকার তেজগাঁও রেল স্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছলে বাহনটির মাঝ বরাবর তিনটি বগিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আগুনে ট্রেনের ভেতরেই জীবন্ত পুড়ে মারা যান মা নাদিরা আক্তার পপি (৩৫) ও তার কোলে থাকা ৩ বছর বয়সি শিশু পুত্র ইয়াসিন রহমান এবং নেত্রকোনা পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি আব্দুর রশিদ ঢালীসহ (৬৫) চারজন।
পরে ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভানোর পর উদ্ধার অভিযান চালিয়ে চারজনের বীভৎস পোড়া লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়। ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করে পুলিশ বু্যরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বিভাগ, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ছাড়াও বিভিন্ন গোয়েন্দা ও তদন্তকারী অন্যান্য সংস্থা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের সিটিটিসির প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ডিআইজি মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান যায়যায়দিনকে বলেন, অগ্নিকান্ডটি পরিকল্পিত। ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত আলামতের পরীক্ষা-নিরীক্ষা অব্যাহত আছে। প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে, পেট্রোলের সঙ্গে পরিমাণমত সালফার মিশিয়ে তৈরি করা উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছে অগ্নিসন্ত্রাস চালানোর জন্য।
তিনি বলেন, পেট্রোলের সঙ্গে সালফারের মতো রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে সবাই অত্যন্ত শক্তিশালী ও কার্যকর বিস্ফোরক তৈরি করতে পারে না। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোর সামরিক শাখার অত্যন্ত দক্ষ ও উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যরাই সাধারণত এ ধরনের বিস্ফোরক তৈরিতে সক্ষম। এছাড়া দেশের অন্যতম প্রধান একটি ইসলামী
দলের ছাত্র সংগঠনের অপারেশনাল বিভাগের প্রশিক্ষিত সদস্যদের অনেকেই এ ধরনের উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক তৈরিতে সক্ষম। তারাই এ ধরনের নাশকতা চালাতে পারে। তবে এমন বিস্ফোরক ছড়িয়ে দেয়ার পর তাতে ম্যাচ বা অন্য কোনো কিছু দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ এ ধরনের উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক ছিটিয়ে দেয়ার পর আপনা আপনি সাধারণত আগুন ধরে না।
পুলিশের তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই প্রধান পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার যায়যায়দিনকে বলেন, ট্রেনে অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। ইতোমধ্যেই অনেক আলামত ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। সংগৃহীত ফুটেজের পর্যালোচনা চলছে নানাভাবে।
তিনি আরও বলেন, পর্যালোচনায় দেখা গেছে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বেশ কয়েকজন বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে অন্যের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে টিকিট কিনে। যাদের নামে টিকিট কেনা হয়, তারা ট্রেনে চড়েনি। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সেই টিকিট দিয়ে অন্যরা বা নাশকতাকারীরা ট্রেনটিতে উঠে।
এই পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, ট্রেনটি তেজগাঁও রেলস্টেশনের কাছাকাছি যাওয়ার পর তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে যথেষ্ট টাইমিং করা হয়েছে। নাশকতাকারীরা জানত আগুন কত সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। ট্রেনটির গতি যেহেতু ঘণ্টায় ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার ছিল, সেই অনুযায়ী তারা আগুন দেয়। ট্রেনে আগুন দেয়ার ঘটনাটি ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশন পার হওয়ার পর দেওয়া হতে পারে। যাতে করে তেজগাঁও রেলস্টেশন পর্যন্ত যেতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে এবং ট্রেনটি থামতে বাধ্য হয়।
তিনি আরও জানান, স্বাভাবিক কারণেই ট্রেনের মাঝ বরাবর অগ্নিকান্ডের ঘটনায় যাত্রীরা আগুন আগুন বলে চিৎকার করতে থাকেন। এমন চিৎকারে তেজগাঁও রেলস্টেশন কর্তৃপক্ষ ট্রেন থামার নির্দেশ দেয়। ট্রেন থামলে যাত্রীরা যে যার যার মতো নেমে নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে থাকেন। এমন সুযোগে নাশকতাকারীরাও সাধারণ যাত্রীদের ভিড়ে মিশে পালিয়ে যায়।
অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার আরও জানান, তদন্তে বেশ কয়েকটি বেনামি টিকিট কেনার তথ্য পাওয়া গেছে। যাদের নামে টিকিট কেনা হয়েছে, তাদের শনাক্ত করার কাজ চলছে। একই সঙ্গে অন্যের নামে টিকিট কিনে যারা ট্রেনে চড়ে ছিল, তাদেরকেও শনাক্ত করার চেষ্টা অব্যাহত আছে। তদন্তে এমন বেশ কয়েকজন সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, দুটি পক্ষের যে কোনো একটি পক্ষের এক বা একাধিক জনকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হলেই পুরো ঘটনার রহস্য বেরিয়ে আসবে। যদিও মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তবে পিবিআইয়ের সদস্যরা ঘটনার রহস্য উদঘাটনে গভীরভাবে অনুসন্ধান করে যাচ্ছেন। তদন্তেও বেশ অগ্রগতি আছে। ঘটনাটির রহস্যের কিনারা হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান যায়যায়দিনকে জানান, নাশকতাকারীরা যাত্রীবেশে ট্রেনে উঠেছিল। তেজগাঁও রেলস্টেশনে ট্রেন পৌঁছার আগ মুহূর্তে তিনটি বগিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েই তারা অন্য যাত্রীদের সঙ্গে ভিড়ে মিশে পালিয়ে যায়। বিমানবন্দর রেলস্টেশনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে পুড়ে যাওয়া তিনটি বগিতে তিন জনকে উঠতে দেখা গেছে। তাদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
তেজগাঁও রেলস্টেশনের মাস্টার মো. শফিকুল ইসলাম যায়যায়দিনকে জানান, ঘটনার সময় ট্রেনটিতে ইঞ্জিন (লোকোমোটিভ) ছাড়া মোট ১৫টি বগি ছিল। ইঞ্জিনের পেছনে থাকা ৬টি বগির পরে ছ, জ ও ঝ নম্বর বগিতে অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি ঘটে। তিনটিই 'শোভন চেয়ার' বগি ছিল। ট্রেনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আগুন লাগেনি বলে এখন পর্যন্ত জানা গেছে। ট্রেনটি মঙ্গলবার রাত ১২টার পর নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ ছাড়ে।
এদিকে ট্রেনে নাশকতার ঘটনায় জড়িতরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিহত শিশু ইয়াসিন রহমানের মামা রায়হান। তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, নাশকতামূলক অগ্নিকান্ডে আমার বোন ও ভাগিনা ইয়াসিন জীবন্ত পুড়ে মারা গেল। অথচ ঘটনার প্রায় একমাস হতে চললেও ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা গ্রেপ্তার হচ্ছে না। এটি মানা যায় না। কারণ আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নেটওয়ার্ক অনেক শক্তিশালী। আমি এমন জীবন্ত হত্যাকান্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ ট্রেনে বা যাত্রীবাহী যানবাহনে আগুন দেয়ার সাহস না করে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার পরপরই অগ্নিসন্ত্রাসে জড়িত থাকার অভিযোগে ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তবে তাদের কাছ থেকে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে নাশকতা চালানোর বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য মেলেনি। তাদের যোগাযোগ ও গতিবিধি নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ যায়যায়দিনকে বলেন, ডিবিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে আমরা ঘটনাটির গভীর তদন্ত করছি। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা অব্যাহত আছে।
র্
যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন যায়যায়দিনকে বলেন, ঘটনাটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে আমাদের গোয়েন্দারা কাজ করছে।