সংসদ নির্বাচনের ইতিহাসে এবারই সর্বোচ্চসংখ্যক নারী ভোটে লড়াই করেছেন; তবে আগের বারের তুলনায় নির্বাচিত নারী সংসদ সদস্যের সংখ্যা কমেছে।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ২৯৮টি আসনের ফলে দেখা যায়, এবার জয়ের মুখ দেখেছেন ১৯ জন নারী, যেখানে একাদশ সংসদ নির্বাচনে এই সংখ্যা ছিল ২২।
আর অঘোষিত ময়মনসিংহ-৩ আসনে এগিয়ে রয়েছেন এক নারী প্রার্থী। এর বাইরে একজন প্রার্থীর মৃতু্যর কারণে নওগাঁ-২ আসনের নির্বাচন বাতিল করা হয়েছে। সেখানে আগামী ১২ ফেব্রম্নয়ারি নির্বাচন হবে, যদিও সেখানে কোনো নারী প্রার্থী নেই।
এবার জয় পাওয়া ১৯ নারী প্রার্থীর মধ্যে ১৫ জন আওয়ামী লীগ মনোনীত; বাকি ৪ জন স্বতন্ত্র হিসেবে লড়াই করেন।
বাকি যে ৭৭ জন নারী জিততে পারেননি, তদের মধ্যে মমতাজ বেগম, মেহের আফরোজ চুমকি ও সানজিদা খানমের মতো শক্তিশালী প্রার্থীও ছিলেন।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৬৮ নারী প্রার্থী অংশ নিলেও এবার সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়ায় ৯৬। তার মানে আগের তুলনায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে ৪১ দশমিক ১৮ শতাংশ।
তবে আগেরবার ২২ জন নারী জনরায় নিয়ে সংসদে গিয়েছিলেন, যেটি দেশের নির্বাচনী ইতিহাসে সর্বোচ্চসংখ্যক নারীর জয়ের রেকর্ড। সেবার জাতীয় পার্টি থেকে দু'জন ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ থেকে একজন নারী প্রার্থী নির্বাচিত হলেও এবার অন্য কোনো দলের নারী প্রার্থীরা জয় পায়নি।
জয়ীর সংখ্যা কমলেও নারীরা এবার ভালো করেছে বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির।
তিনি বলেন, "নারীদের যে জয়ের সংখ্যা, সেটা মোটেও সন্তোষজনক না, কিন্তু তুলনামূলকভাবে পুরুষ প্রার্থীদের চেয়ে নারী প্রার্থীরা বেশি ভালো করেছে। কারণ পুরুষ প্রার্থী তো অনেক ছিল। শতকরায় হিসাব করলে দেখা যাবে, পুরুষদের হারার হার বেশি।"
নারী প্রার্থী বাড়ানোর তাগিদ :জাতীয় নির্বাচনে কতজন নারী জয় পেল, সেটার চেয়ে ভোটের লড়াইয়ে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ১৯৭০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তাদের মধ্যে নারীদের (৯৬ জন) অংশগ্রহণের হার ৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ২০। জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ কংগ্রেস ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপি নয়জন করে, তৃণমূল বিএনপি ছয়জন, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ তিনজন করে এবং গণফ্রন্ট ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি দু'জনকে করে নারী প্রার্থী দেয়।
এছাড়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, জাতীয় পার্টি-জেপি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম, কল্যাণ পার্টি ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি একজন করে নারী প্রার্থী দিয়েছে।
মানবাধিকার কর্মী খুশি কবির মনে করেন, নারী নেতৃত্বকে এগিয়ে নিতে আগে রাজনৈতিক
দলগুলোর মানসিকতা বদলাতে হবে।
তিনি বলেন, "আমাদের মানসিকতাই হল নারীদেরকে আমরা নমিনেশন দেই না। ভেবে-চিন্তে পারবে কি পারবে না, আমরা এসব দেখি। কোনো পুরুষ প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়ার সময় যোগ্য কি যোগ্য না, সেটা চিন্তা করা হয় না। আসলে মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। সমাজেরও, কিন্তু সমাজ তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীদের নিয়ে আসছে। দলের ভূমিকাটা এখানে মুখ্য।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার মনে করছেন, নির্বাচনের সময় দল মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে জয়ী প্রার্থী খোঁজে। ফলে লিঙ্গ সমতার বিষয়টি তারা মাথায় নেন না।
তিনি বলেন, "জয়ের সংখ্যাটা অবশ্যই উৎসাহব্যাঞ্জক নয়। যতক্ষণ নারীরা দলের মধ্যে উপরের দিকে উঠবার জায়গা ঠিকঠাক মত না পাচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত কতজন জিতল সেটা পরের কথা, কতজন মনোনয়ন পেল- সেটাই বড় কথা।"
গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে দেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নারী নেতৃত্বের হাতেই থাকছে। সংসদ ও সংসদের বাইরে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নারীদের দেখা যাচ্ছে। তবে সামগ্রিক রাজনীতিতে নারীরা পিছিয়েই থাকছে।
সংরক্ষিত আসনে প্রতিনিধিত্ব করতে ৫০ জন নারী জাতীয় সংসদে যান। তবে জনরায় নিয়ে এর অর্ধেক নারীও কোনো সংসদে যেতে পারেননি।
১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় নির্বাচনে ৩৯ জন নারী প্রার্থী অংশ নেন, যাদের মধ্যে পাঁচজন জয়ী হয়ে সংসদে যান।
ষষ্ঠ জাতীয় নির্বাচনে ৩৬ নারী প্রার্থীর আটজন, সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩৮ নারী প্রার্থীর ছয়জন, অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫৯ নারীর মধ্যে ১৯ জন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯ নারী প্রার্থীর ১৮ জন নির্বাচিত হন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৬৯ আসনে জনপ্রতিনিধি হতে লড়েন ৬৮ নারী, যাদের মধ্যে রেকর্ড ২২ জন সরাসরি নির্বাচিত হয়ে সংসদে যান।
সমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে 'নারীবিদ্বেষী মনোভাব' থাকার কথা উলেস্নখ করে শান্তনু মজুমদার বলেন, "এটা হচ্ছে সারা বছর ধরে নারীর রাজনীতিক ও মনোনয়ন পাওয়ার যোগ্য হয়ে ওঠার লড়াই।"
"কারণ এখন বাঙালি পরিবারগুলো, বাঙালি সমাজ নারীর ঘরের বাইরে যাওয়া দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে; কিন্তু রাজপথে নারী কোনো দলের পক্ষে স্স্নোগান দিচ্ছে, রাজনীতি করছে- এমন নারীকে সাদরে বরণ করা হয় না।"
অধ্যাপক শান্তনু বলেন, "দলের ভেতর থেকেই অনেক সহকর্মী নারীদের রাজনীতির পথে কাঁটা বিছিয়ে দেন। যাদের পথে কাঁটা বিছাতে পারেন না, তাদের নারী উইংগুলো পাইয়ে দেন, যেমন- মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক এমন। এটা তাদের জন্য ভয়ঙ্কর বিপদ। এরপরে সে আর পরবর্তী ৫-৬ বছর মূল কমিটিতে জায়গা করে নিতে পারছেন না।"
এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, যেসব নারীর কোনো 'পলিটিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড' নেই, তাদের জন্য দল খুবই প্রতিকূল একটা জায়গা।
"নির্বাচনের ফান্ড, গুন্ডামির সক্ষমতা- এসবও নারীর নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে সবাই শেখ হাসিনা বা হিলারি ক্লিনটন না।"
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জয়ী হওয়া নারীরা
আওয়ামী লীগ : (রংপুর-৬) শিরীন শারমিন চৌধুরী, (গাইবান্ধা-৩) উম্মে কুলসুম স্মৃতি, (বগুড়া-১) সাহাদারা মান্নান, (সিরাজগঞ্জ-২) জান্নাত আরা হেনরি, (বাগেরহাট-৩) হাবিবুন নাহার, (বরগুনা-২) সুলতানা নাদিরা, (শেরপুর-২) মতিয়া চৌধুরী, (কিশোরগঞ্জ-১) সৈয়দা জাকিয়া নূর, (মুন্সীগঞ্জ-২) সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি, (গাজীপুর-৩) রুমানা আলী, (গাজীপুর-৪) সিমিন হোসেন রিমি, (গোপালগঞ্জ-৩) শেখ হাসিনা, (চাঁদপুর-৩) দীপু মনি, (চট্টগ্রাম-২) খাদিজাতুল আনোয়ার এবং (কক্সবাজার-৪) আসনে শাহীন আক্তার।
এর বাইরে ময়মনসিংহ-৩ আসনে আওয়ামী লীগের নিলুফার আনজুম পপি নৌকা প্রতীকে প্রায় এক হজার ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে আছেন। আসনটির একটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত থাকায় ফলাফল ঘোষণা করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। ওই কেন্দ্রে ১৩ জনুয়ারি ভোট হবে।
স্বতন্ত্র : (গাইবান্ধা-১) আব্দুলস্নাহ নাহিদ নিগার, (মাদারীপুর-৩) মোসা. তাহমিনা বেগম, (সুনামগঞ্জ-২) জয়া সেনগুপ্তা ও (হবিগঞ্জ-১) আসনে আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী জয়ী হয়েছেন।