দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পার্বত্য ৩ জেলায় জয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব যাচ্ছে কার হাতে, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। বর্তমান পার্বত্যমন্ত্রী ও বান্দরবানের সংসদ সদস্য বীর বাহাদুর, খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এবং রাঙামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদারের সমর্থক ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানাভাবে তাদের নিজ নিজ এলাকায় সংসদ সদস্যকে মন্ত্রী করার দাবি তুলেছেন। পার্বত্য শান্তি চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য মন্ত্রণালয়টি একমাত্র পাহাড়িদের জন্য সংরক্ষিত থাকায় ইতোমধ্যে এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেতে ওপর মহলে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা। এছাড়া জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্য হতেও সম্ভাব্যরা লবিং শুরু করেছেন বলে একাধিক সূত্র দাবি করেছে।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তির কারণে ১৯৯৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় করে সরকার। এ বছর পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের প্রথম পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী করা হয় খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য প্রয়াত কল্পরঞ্জন চাকমা। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকাকালে প্রধানমন্ত্রীর হাতে পূর্ণমন্ত্রীর ক্ষমতা রেখে সে সময় রাঙামাটির সংসদ সদস্য মণিস্বপন দেওয়ানকে উপমন্ত্রী করা হয়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাকমা সার্কেল ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়কে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী নিয়োগ করা হয়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাঙামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদারকে প্রতিমন্ত্রী এবং ২০১৪ সালে বান্দরবানের সংসদ সদস্য বীর বাহাদুর উশেসিংকে প্রতিমন্ত্রী করা হয়। ২০১৯ সালে বীর বাহাদুরকে পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ফলে দ্বাদশ সংসদে কে পাচ্ছেন পাহাড়ের সর্বোচ্চ পদ, তা নিয়ে নেতাকর্মীদের মাঝে আলোচনার কমতি নেই।
রাঙামাটি আসনে দীপংকর তালুকদার পঞ্চমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এর আগে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০৮ ও ২০১৮ সালেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০৮ সালে মহাজোট সরকারের আমলে পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী এবং এর আগের দফায় তিনি উপজাতীয় শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া তিনি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। দুই দফায় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলেও ২০১৪ সালে রাঙামাটি আসনে আঞ্চলিক সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী সংসদ সদস্য থাকায় আওয়ামী লীগ অনেকটা কোণঠাসা ছিল। তখন দলকে চাঙ্গা ও সুসংগঠিত করতে দীপংকর তালুকদারের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা প্রতিরোধ বাহিনীর অন্যতম সদস্য হিসেবে ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের প্রতিরোধে অংশ নেন তিনি। ফলে মন্ত্রিত্ব পাওয়ার দৌড়ে তিনি এগিয়ে আছেন বলে দাবি তার কর্মী-সমর্থকদের।
জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক হাজী মুছা মাতব্বর বলেন, 'আমরা রাঙামাটিবাসী পাহাড়ি বাঙালি ঐক্যের প্রতীক দীপংকর তালুকদারকে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাই। ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও ২০১৪ সালের পর রাঙামাটিবাসী মন্ত্রিত্ব পাওয়া থেকে বঞ্চিত ছিল।'
খাগড়াছড়ি থেকে তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। ২০০৮ সালে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানের জন্য লবিং করলেও শেষ সময় এসে তাকে প্রতিমন্ত্রীর পদমযার্দায় উপজাতীয় শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান করা হয়। তিনি পর পর দুবার টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।
খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের উপ দপ্তর সম্পাদক ও প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল আজম বলেন, 'কল্পরঞ্জন চাকমার পর খাগড়াছড়িবাসী মন্ত্রিত্ব পাওয়া থেকে বঞ্চিত ছিল, তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাকে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান জেলাবাসী।
বান্দরবান থেকে বীর বাহাদুর উশেসিং টানা সপ্তম বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১৪ সালে প্রতিমন্ত্রী ও ২০১৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন তিনি।
বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লক্ষ্ণীপদ দাশ বলেন, 'নতুন বছরে এই পার্বত্য বীরকে (বীর বাহাদুর) আমরা মন্ত্রিসভায় তৃতীয়বার পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাই। যাতে তিনি পূর্ণ ক্ষমতা নিয়ে দেশ ও জাতির সেবা করতে পারে।
লক্ষ্ণীপদ দাশ আরও জানান, বীর বাহাদুর উশৈসিং একজন সৎ নির্ভীক ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ। দীর্ঘ ৩০ বছর তিনি পার্বত্য জেলা বান্দরবান থেকে সফল এমপি হিসেবে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে পার্বত্য এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। বীর বাহাদুরের আমলেই পাহাড়ে শান্তির ধারা অব্যাহত রয়েছে। তার বিরুদ্ধে কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ নেই, তিনি তিন পার্বত্য জেলায় সুষম উন্নয়ন করেছেন।