বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১

বায়ুদূষণে বারবার শীর্ষে ঢাকা আইন আছে, প্রয়োগ নেই

বাড়ছে অসংক্রামক রোগে মৃতু্যহার বছরে ১০ শতাংশ হারে দূষণ বাড়ছে
বীরেন মুখার্জী
  ০৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
আপডেট  : ০৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:২৭
বায়ুদূষণে বারবার শীর্ষে ঢাকা আইন আছে, প্রয়োগ নেই

চলতি বছরের প্রথম দিন থেকেই বায়ুদূষণে বারবার শীর্ষে উঠে আসছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার নাম। আবহাওয়ার মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) সূচক অনুযায়ী, বছরের ছয় দিনে বিশ্বের অন্তত ১১০টি দেশের মধ্যে চার দিন শীর্ষে উঠেছে ঢাকা। শেষ দিন শনিবার দূষণের তালিকায় ২৯২ স্কোর নিয়ে 'খুবই অস্বাস্থ্যকর' ছিল ঢাকার বাতাস। বছরের প্রথম দিন ২৪৬ স্কোর, ২ জানুয়ারি ২৬৪ স্কোর ও ৪ জানুয়ারি ৩০৬ স্কোর নিয়ে ঢাকার অবস্থান ছিল প্রথম।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ২০১৬ সালের পর ২০২৩ সালে ঢাকার বায়ুমান সবচেয়ে খারাপ ছিল। আর বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় চলতি বছরও বায়ুদূষণে ঢাকার অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হবে কিনা- এমন আশঙ্কায় রয়েছেন তারা।

একিউআইর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণাই (পিএম ২.৫) দূষণের প্রধান উৎস। ঢাকার বাতাসে যতটা এই বস্তুকণা আছে তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিস্নউএইচও) মানদন্ডের চেয়ে ৩৮ থেকে ৫০ গুণ বেশি। সংস্থাটির মানদন্ড অনুযায়ী, স্কোর ৫১-১০০ হলে তাকে 'মাঝারি' বা 'গ্রহণযোগ্য' মানের বায়ু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১০১-১৫০ স্কোরকে 'সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর' ধরা হয়। স্কোর ১৫১-২০০ হলে তা 'অস্বাস্থ্যকর' বায়ু। স্কোর ২০১-৩০০ হলে তাকে 'খুবই অস্বাস্থ্যকর' বায়ু ধরা হয়। ৩০১ থেকে তার ওপরের স্কোরকে 'দুর্যোগপূর্ণ' বা 'ঝুঁকিপূর্ণ' ধরা হয়।

জলবায়ু বিশ্লেষকদের মতে, ভৌগোলিক কারণে প্রতি বছর শীতের সময় ঢাকার বায়ুদূষণ বাড়লেও এবার শীত মৌসুম শুরুর বেশ আগে থেকেই রাজধানীর বাতাসে দূষণের পরিমাণ বেড়েছে। যে কারণে দূষণের দিক থেকে প্রায়ই শীর্ষে উঠে আসছে ঢাকার নাম। বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইকিউ এয়ারের সূচকে গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ঢাকা একাধিকবার ৩০০র বেশি একিউআই স্কোর নিয়ে সর্বোচ্চ দূষিতের তালিকায় নাম লিখিয়েছে।

স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ-এর পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ডিন মি. মজুমদার সম্প্রতি একটি সংবাদ মাধ্যমকে জানান, গত ৮ বছরের তুলনায় বর্তমানে ১০ ভাগেরও বেশি বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পেয়েছে যা একটা বড় শঙ্কার বিষয়।

তবে বারবার দূষণের তালিকায় ঢাকার শীর্ষে চলে আসার পেছনে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণকে চিহ্নিত করেছেন পরিবেশবাদীরা। তাদের মতে, বড় বড় প্রকল্পের নির্মাণ কাজ চলায় বায়ুদূষণ বাড়ছে। যে কোনো ধরনের নির্মাণ কাজের সময় বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে সেসব নিয়ম পালনের তোয়াক্কা করতে দেখা যায় না।

রাস্তা ও ভবন নির্মাণ বা মেরামতের সময় ধুলাবালি যেন বাতাসের সঙ্গে মিশে না যায় সেজন্য নির্মাণ স্থানে যথাযথ অস্থায়ী ছাউনি বা বেষ্টনী দেয়ার নিয়ম রয়েছে। সেইসঙ্গে, বেষ্টনীর ভেতর ও বাইরে নির্মাণ সামগ্রী (মাটি, বালি, রড, সিমেন্ট ইত্যাদি) যথাযথভাবে ঢেকে রাখা এবং দিনে কমপক্ষে দুইবার স্প্রে করে পানি ছিটানোর কথা বলা আছে পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশনায়। এছাড়া নির্মাণাধীন রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রেখে বিকল্প রাস্তার ব্যবস্থা করা, দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামত করা এবং নির্মাণ সামগ্রী ঢেকে পরিবহণ করার কথাও বলে অধিদপ্তর। তবে এসব নিয়ম কাগজে-কলমে থাকার মাঝেই সীমাবদ্ধ বলে অভিযোগ তাদের।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর মো. হাদিউজ্জামান একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, 'নির্মাণ স্থলে পানি ব্যবহার করার জন্য

টাকা ধরা থাকলেও ঠিকাদাররা মুনাফা করতে গিয়ে পরিবেশের সাথে কম্প্রোমাইজ করে ফেলছে। যার কারণে আমরা সবাই বিপদের মাঝে আছি।'

বিশেষজ্ঞরা ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য সিটি করপোরেশনকে দুষছেন। কারণ সড়কে নিয়মিত পানি ছিটায় না সিটি করপোরেশন। আবার এ বিষয়টির সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে দ্বিমত পোষণ করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুটো স্প্রে ক্যানন এবং দশটি গাড়ির মাধ্যমে মহাসড়কে নিয়মিত পানি ছিটাচ্ছে ডিএনসিসি।

ইটভাটাও বায়ুদূষণের অন্যতম একটি উৎস। দূষণবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ক্যাপস-এর 'দেশব্যাপী ৬৪ জেলার বায়ুদূষণ সমীক্ষা ২০২১' অনুযায়ী, ঢাকার আশপাশের প্রায় ১২শ' ইটভাটা, ছোট-বড় কয়েক হাজার শিল্প কারখানা আছে, যেগুলো দূষণের অন্যতম কারণ। ইটভাটাগুলো শুষ্ক মৌসুমে চলমান থাকে। শীতকালে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা কম থাকার ফলে এই সময়ে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণাগুলো বাতাসে ভেসে বেড়ায়। ঘটে বায়ুদূষণ। অথচ বায়ুদূষণ হ্রাসের লক্ষ্যে 'ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ (সংশোধিত ২০১৯)' শীর্ষক আইন গৃহীত হলেও আইনের তেমন প্রয়োগ নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণের আরেকটি অন্যতম উৎস ফিটনেসবিহীন গাড়ি। ঢাকা শহরে যে পরিমাণ বাস চলে, তার সত্তর শতাংশেরই আয়ুষ্কাল শেষ। ফলে এর মাধ্যমেও ঘটছে বায়ুদূষণ। কারণ কোনো যানবাহনের আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেলে সেগুলো ঠিকভাবে জ্বালানি পোড়াতে পারে না এবং তখন সেগুলোর ধোঁয়ার সাথে ক্ষতিকর রাসায়নিক নির্গত হয়।

ক্যাপস-এর গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকার যেসব এলাকায় বর্জ্য পোড়ানো হয়, সেসব এলাকাতে বায়ুদূষণ বেশি ঘটে। ময়লার স্তূপ যেখানে থাকে সেখানে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। অনেক সময় এই মিথেন গ্যাসের দুর্গন্ধ থেকে বাঁচার জন্য পরিচ্ছন্ন কর্মীরা আগুন জ্বালায়। শুষ্ক মৌসুমে ঢাকার অন্তত ৫০টি স্থানে পোড়ানো বর্জ্য থেকেও বায়ুদূষণ ঘটছে।

এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে ভারতের অংশ থেকে বাংলাদেশের দিকে বায়ু প্রবাহিত হয়। ফলে দিলিস্নর বায়ুদূষণ চরম আকার ধারণ করলে কয়েকদিনের মধ্যে বাংলাদেশেও বায়ুদূষণের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। আবহাওয়াবিদরা এই দূষণকে বলেন 'রিজিওনাল এয়ার পলিউশন'।

পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনেও ঢাকার বায়ুদূষণের কারণ হিসেবে এসব উৎসকে দায়ী করা হয়েছে। তবে ঢাকার বায়ুর মান উন্নয়নে বিভিন্ন সময় সিটি করপোরেশনকে পানি ছিটিয়ে ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা গেছে। অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান এবং রাস্তার ওপর নির্মাণ সামগ্রী ফেলে রাখার জন্য অভিযান চালিয়ে জরিমানাও করা হয়েছে। বাস্তবতা হলো, এরপরও পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটেনি।

বাংলাদেশ পরিবেশ উন্নয়ন আন্দোলনের মতে, ঢাকায় বায়ুদূষণের পরিমাণ বছরে ১০ শতাংশ করে বাড়ছে। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বায়ুদূষণের ফলে স্ট্রোক, হৃদরোগ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ, পালমোনারি ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যানসার এবং শ্বাসযন্ত্রে তীব্র সংক্রমণের ফলে দেশে মৃতু্যহার বাড়ছে।

জানা যায়, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে জাতীয় কমিটিও রয়েছে সরকারের। এই কমিটি বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবে। এছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় করবে। এই কমিটি ২০২৩ সালে দুবার সভা করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দিয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণেই বায়ুদূষণ রোধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারছে না কোনো পক্ষ। ফলে বায়ুদূষণ রোধের বিষয়টি সেই তিমিরেই থেকে যাচ্ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে