বরিশালের ৬টি আসন

প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, তবুও সরব প্রচারণা

প্রকাশ | ০৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

আরিফুর রহমান, বরিশাল
বরিশাল জেলার ছয়টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৩৫ প্রার্থী। ছয় আসনে চলছে শেষ সময়ের নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা। শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলেও প্রচারণায় ঘাটতি নেই নৌকার প্রার্থীদের। আবার বরিশালের দুটি আসনে নৌকার প্রার্থীই নেই। অন্যদিকে বরিশাল-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলের কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থীও দাঁড়ায়নি। বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া):এ আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা মার্কার হেভিওয়েট প্রার্থী বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে ও বর্তমান সংসদ সদস্য আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আব্দুলস্নাহ। এখানে নেই কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী। আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে তার (হাসানাত) বিজয় অনেকটা সুনিশ্চিত। কারণ হিসেবে জানা গেছে, ওই আসনে জাতীয় পার্টির সেরনিয়াবাত সেকান্দার আলী (লাঙ্গল) ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) মো. তুহিন আম প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও দুই উপজেলার নির্বাচনী এলাকার অধিকাংশ ভোট কেন্দ্রে ওই দুই প্রার্থীর এজেন্ট দেওয়ার মতো কোনো কর্মী-সমর্থক নেই। বরিশাল-২ (উজিরপুর-বানারীপাড়া) : এ আসনে প্রথমে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও দুইবারের সাবেক সাংসদ বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুসকে। শেষপর্যন্ত মহাজোটের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির কারণে ১৪ দলের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননকে ওই আসনটি ছেড়ে দিতে হয়েছে। যদিও রাশেদ খান মেনন নৌকা প্রতীক নিয়েই ভোটের মাঠে নেমেছেন। তালুকদার ইউনুস সভা করে নৌকার প্রার্থী রাশেদ খান মেননের পক্ষে সবাইকে এক হয়ে কাজ করার জন্য অনুরোধ করলেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিষয়টি এখনো মেনে নিতে পারেননি। ওই আসনের হতাশ আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মী জানিয়েছেন, যাকে এ আসনে নৌকা প্রতীক ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তিনি হলেন বরিশাল-৩ আসনের বাসিন্দা। তৃণমূলের মতামতকে উপেক্ষা করে এখানে নৌকা প্রতীক না দেয়ায় সবার মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে। পাশাপাশি এ আসনে মনোনয়ন বঞ্চিতের পর ঢেঁকি প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে লড়ছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মনিরুল ইসলাম এবং ঈগল প্রতীক নিয়ে লড়ছেন শেরে বাংলার দৌহিত্র একে ফাইয়াজুল হক। ইতোমধ্যে বানারীপাড়ায় রাশেদ খান মেননের সভা চলাকালীন সময় আওয়ামী লীগের দুই গ্রম্নপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। সূত্রমতে, ওই আসনের আওয়ামী লীগের বৃহৎ অংশের নেতাকর্মীরা নৌকা ছেড়ে ঈগল মার্কার পক্ষে কাজ করছেন। এই আসনে অপর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা হলেন-কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রার্থী নকুল কুমার বিশ্বাস (গামছা), তৃণমূল বিএনপির আলহাজ্ব মো. শাহজাহান সিরাজ (সোনালী আঁশ) ও এনপিপি'র সাহেব আলী (আম)। আর জাতীয় পার্টির ইকবাল হোসেন তাপস (লাঙ্গল) এরই মধ্যে কর্মিসভা করে নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিয়েছেন। বরিশাল-৩ (মুলাদী-বাবুগঞ্জ) : এখানে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হয়ে অনেকটা নির্বাচনী মাঠ গুছিয়ে নিয়েছিলেন নৌকার প্রার্থী সরদার মো. খালেদ হোসেন স্বপন। কিন্তু তা বেশিদিন টিকেনি। শেষপর্যন্ত তিনিও (স্বপন) মহাজোটের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির কবলে পরে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছেন। এখানে জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী গোলাম কিবরিয়া টিপুকে আসনটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি (টিপু) লাঙল প্রতীক নিয়ে নির্বাচনী মাঠে লড়ছেন। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মী জানিয়েছেন, এখনো মহাজোটের প্রার্থী তাদের কাউকে ডাকেনি। বিগত দিনের মতো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তিনি কোণঠাসা করে রাখতে চাচ্ছেন। তাই বাধ্য হয়ে তারা এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে নৌকা মার্কার প্রার্থী না থাকায় ট্রাক মার্কার স্বতন্ত্র প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সদস্য মো. আতিকুর রহমানের বিজয় নিশ্চিত করতে কাজ শুরু করেছেন। বাবুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মাসুম মাঝি বলেন, এ আসনে নৌকা প্রতীক না থাকায় নেতাকর্মীরা হতাশ। তাই এখানকার উন্নয়নের স্বার্থে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সদস্য আতিকুর রহমানের সঙ্গে মাঠে নেমেছেন। এই আসনে অপর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা হলেন- ড. মোহাম্মদ আমিনুল হক কবির (ঈগল মার্কা), ওয়ার্কার্স পার্টির অ্যাডভোকেট শেখ মো. টিপু সুলতান (হাতুড়ি), সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের আজমল হাসান জিহাদ (ছড়ি) ও তৃণমূল বিএনপির শাহানাজ হোসেন (সোনালী আঁশ)। বরিশাল-৪ (মেহেন্দীগঞ্জ-হিজলা): একসময়ের বিএনপি ও জামায়াত অধু্যষিত এ আসনটি নানা কৌশলে বাগিয়ে আনেন সাবেক আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী পঙ্কজ দেবনাথ। টানা দুইবারের এমপি পঙ্কজ দেবনাথ ওই আসনকে আওয়ামী লীগের ঘাঁটিতে পরিণত করেছেন। কিন্তু জেলা আওয়ামী লীগের সফঙ্গ তার বিরোধের সূত্রধরে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে তিনি দলের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয় দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মি আহমেদকে। নেতাকর্মী ও সমর্থকদের অনুরোধে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষদিন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অনলাইনের মাধ্যমে মনোনয়নপত্র জমা দেন পঙ্কজ দেবনাথ। এরপরই ভাগ্য খুলতে শুরু করে তার। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের সময় তিনি (পঙ্কজ) নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকার অভিযোগ এনে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। যার প্রমাণ পাওয়ায় নৌকার প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল ঘোষণা করা হয়। রিটার্নিং কর্মকর্তার এ রায়ের বিরুদ্ধে নৌকার প্রার্থী ইসির কাছে আপিল করেও কোনো সুফল না পেয়ে হাইকোর্টে আপিল করেন। সেখানেও নৌকার প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়। ফলে ভাগ্য খুলতে শুরু করেছে ঈগল মার্কা নিয়ে নির্বাচনী মাঠে থাকা বর্তমান সংসদ সদস্য ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থী পঙ্কজ দেবনাথের। ওই আসনে জাতীয় পার্টির মিজানুর রহমান (লাঙ্গল) ও সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের হৃদয় ইসলাম চুন্নু (ছড়ি) প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও তাদের তেমন কোনো কর্মী-সমর্থক নেই। বরিশাল-৫ (সদর) : নানা নাটকীয়তার পর অবশেষে এ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সদ্য সাবেক সিটি মেয়র মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুলস্নাহর প্রার্থিতা বৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত করেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। এ রায়ের কারণে সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুলস্নাহ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পাচ্ছেন না। যে কারণে এ আসনে অনেকটা বিজয়ের পথে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা মার্কার প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম। ইতোমধ্যে প্রচার-প্রচারণায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পুরো নির্বাচনী এলাকা সরগরম করে রেখেছেন। নৌকার প্রার্থীর সমর্থকদের পাশাপাশি এ আসনে বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন দলের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া ট্রাক মার্কার প্রার্থী আলহাজ্ব মো. সালাহউদ্দিন রিপন। নির্বাচন বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ আসনে নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে ট্রাক মার্কার প্রার্থীর হাড্ডাহাড্ডি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ আসনের অপর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা হলেন- এনপিপির আব্দুল হান্নান সিকদার (আম), সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের মো. আসাদুজ্জামান (ছড়ি) ও বাংলাদেশ কংগ্রেসের মাহাতাব হোসেন (ডাব)। অঅর জাতীয় পার্টির ইকবাল হোসেন তাপস (লাঙ্গল) নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার ঘোষণা দিয়েছেন। বরিশাল-৬ (বাকেরগঞ্জ) : টানা ২২ বছর পর মহাজোটের আসনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুল হাফিজ মলিস্নক প্রচারণার মাঠে ভোট চাচ্ছেন। তবে জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বর্তমান সংসদ সদস্য নাসরিন জাহান রতনার পাশাপাশি বাকেরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুল আলম চুন্নু স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় এ আসনে নৌকার প্রার্থীর বিজয়ী হওয়ার পথটা মসৃণ হবে না। স্থানীয়দের দাবি, আওয়ামী লীগে ভর করেই জাতীয় পার্টিকে বিগত তিনটি সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হতে হয়েছে। তবে টানা তিনবার জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার ও তার স্ত্রী জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য নাসরিন জাহান রতনা এই আসনের সংসদ সদস্য থাকায় তাদের অবস্থানের সঙ্গে দলেরও অবস্থান বেশ জোরালো হয়েছে বলে দাবি করেছেন দলের স্থানীয় নেতারা। বাকেরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ট্রাক মার্কার স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ শামসুল আলম চুন্নু বলেন, দলের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ আমাকে সাপোর্ট দিচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করতে চাই। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে বিপুল ভোটে আমি বিজয়ী হবো। জাতীয় পার্টির প্রার্থী এখনই কিছু বলতে নারাজ হলেও তার সমর্থকরা জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী। অপরদিকে নৌকা মার্কার প্রার্থী আব্দুল হাফিজ মলিস্নক বলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আমার সঙ্গে আছেন এবং যারা নেই তারাও অচিরে নৌকার পক্ষে কাজ শুরু করবেন। এ আসনের অপর প্রার্থীরা হলেন-তৃণমূল বিএনপির টিএম জহিরুল হক (সোনালী আঁশ), এনপিপির মো. মোশারফ হোসেন (আম), জাসদের মোহাম্মদ মোহসীন (মশাল), বাংলাদেশ কংগ্রেসের মো. মাইনুল ইসলাম (ডাব), স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. শাহবাজ মিঞা (ঈগল), কামরুল ইসলাম খান (তরমুজ) ও জাকির খান সাগর (রকেট)।