ইতিহাসের সাক্ষী দৃষ্টিনন্দন তেলিয়াপাড়া স্মৃতিসৌধ

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার। ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে লাখো বাঙালি অকাতরে প্রাণ বিলিয়েছেন দেশের জন্য। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে লড়াই করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন অনেকেই। তাদের কেউ আমাদের চেনা, কেউবা অচেনা। বাঙালির শ্রেষ্ঠ এই সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উজ্জীবিত রাখতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নির্মিত হয়েছে ভাস্কর্য ও স্মৃতিফলক। এছাড়া প্রতিটি এলাকায় ছড়িয়ে আছে বধ্যভূমি।

প্রকাশ | ২০ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

মো. নূরল হক কবির
তেলিয়াপাড়া স্মৃতিসৌধ -যাযাদি
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের আত্মত্যাগ স্মরণে দেশজুড়ে নির্মিত স্মৃতিসৌধগুলোর মধ্যে বিশেষ স্থান দখল করে আছে হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া স্মৃতিসৌধ। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম বৈঠককে স্মরণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত এই স্মৃতিসৌধটি জেলার মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে অবস্থিত। উপরে ধাবমান বুলেটের আকৃতিতে তৈরি এই সৌধের সামনে দুটি ফলকে লেখা রয়েছে কবি শামসুর রাহমানের 'স্বাধীনতা তুমি' কবিতাটির কয়েক লাইন। স্মৃতিফলকে আরও রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে তেলিয়াপাড়ার ঘটনাচক্রের সঙ্গে সরাসরি জড়িত এমন ৩৩ জনের নামের তালিকা। যেখানে রাজনৈতিক নেতা, সাবেক সেনা ও সরকারি কর্মকর্তা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নাম। তারা হলেন সম্মুখ সমরের মুক্তিযোদ্ধা। চারদিকে ঘন চা-গাছের সবুজ বেষ্টনীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এ স্মৃতিসৌধ। পাশেই রয়েছে মনোরম সুবিস্তৃৃত লেক। এই সরোবরে ফোটে লাল শাপলা। শীতকালে লেকটিতে পানি কমে গেলেও বর্ষায় থাকে টইটম্বুর। যা এক মনোরম রূপ লাভ করে। পুরোপুরি প্রাকৃতিক গাছগাছালি পরিবেশবেষ্টিত বাংলাদেশের ব্যতিক্রমী স্মৃতিসৌধ এটি। সেজন্য সারা বছরই এখানে পর্যটকদের সমাগম থাকে। একদিকে দৃষ্টিনন্দন, অপরদিকে ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ এ স্মৃতিসৌধ। ঢাকা-সিলেট পুরনো মহাসড়কের পাশেই তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ব্যবস্থাপক বাংলোর পূর্ব-দক্ষিণ কোণে নির্মাণ করা হয়েছে এ সুদৃশ্য স্মৃতিসৌধটি। মুক্তিযুদ্ধের ২নং সেক্টর (ঢাকা, নোয়াখালী, ফরিদপুর ও কুমিলস্নার অংশবিশেষ), ৩নং সেক্টর (কুমিলস্না, কিশোরগঞ্জ ও হবিগঞ্জ), ৪নং সেক্টর (মৌলভীবাজার ও সিলেটের পূর্বাংশ) শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মরণে রাখতে ও তাদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হলেও মূলত এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এক অধ্যায়। ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ব্যবস্থাপকের বাংলোতে ২৭ সেনা অফিসার মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল প্রণয়নে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হন। এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের জন্য এ স্থানটিকে \হনির্বাচন করার কারণ, মুক্তিযুদ্ধের বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারত এখান থেকে খুবই কাছে। আর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর জন্যও এলাকাটি দুর্গম। যেখানে সহজে তাদের হামলা করা দুরূহ। এ সভায় মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল, সারাদেশকে কয়েকটি সেক্টরে ভাগ করা ও মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়। রণকৌশলের অংশ হিসেবে সারাদেশকে প্রথমে ৪টি সেক্টরে ভাগ করলেও একই সভায়ই তা ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। এ সভায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি মেজর জেনারেল এম এ জি ওসমানী, উপ-সেনাপতি মেজর জেনারেল এম এ রব, সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউলস্নাহ, মেজর জেনারেল সি আর দত্ত, সাবেক সেনাপ্রধান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর জেনারেল আব্দুল মতিন, মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ, কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী, ভারতের ব্রিগেডিয়ার শুভ্র মানিয়ম, এমপিএ মৌলানা আসাদ আলী, লেফটেন্যান্ট সৈয়দ মুহম্মাদ ইব্রাহীম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। জেনারেল ওসমানী ও কর্নেল রবের নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধের নকশা প্রণয়ন এবং যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার শপথ চূড়ান্ত করা হয়। শপথবাক্য পাঠ করান এম এ জি ওসমানী। ওই বৈঠকে হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়াতে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের সদরদপ্তর ও সরকারের শপথ পড়ানোর ব্যাপারেও আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরে কৌশলগত কারণে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার ভবেরপাড়ার আম্র্রকাননে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার গঠন করা হয়। তবে তেলিয়াপাড়া চা-বাগান ব্যবস্থাপক বাংলোটিকে পরে মুক্তিযুদ্ধের ৩ নম্বর সেক্টর কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কুমিলস্না, কিশোরগঞ্জ ও হবিগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় এখান থেকেই। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর কে এ শফিউলস্নাহ (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) ও মেজর এ এন এম নুরুজ্জামান (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর)। এ সভাই মূলত আমাদের বাহিনীকে সাংগঠনিক রূপ দেয় এবং তা মুক্তিবাহিনী পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করে। বৈঠক শেষে এম এ জি ওসমানী নিজের পিস্তলের ফাঁকা গুলি ছুড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। আর সেই থেকেই শুরু হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধের মুক্তিবাহিনীর আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ। বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে চালানো হয় গেরিলা যুদ্ধ। দেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাচক্রের সঙ্গে জড়িত তেলিয়াপাড়ায় এ স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে এ স্মৃতিসৌধের উদ্বোধন করেন সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম শফিউলস্নাহ। সেই ছুড়া বুলেটকে স্মরণীয় করে রাখতেই বুলেট আকৃতির স্মৃতিসৌধ। এছাড়া মেহেরপুরের মুজিবনগরে তেলিয়াপাড়ার সেই ঐতিহাসিক সভার আদলে যে ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে, সেটিও তেলিয়াপাড়ায় নির্মাণে প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল। পরে সিদ্ধান্ত বদলে তা প্রথমে মুজিবনগরে এবং পরে তেলিয়াপাড়ায় নির্মাণ করা হয়।