শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই

মহান মুক্তিযুদ্ধে কুমিলস্না সদরসহ বিভিন্ন উপজেলার চেনা-অচেনা অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উজ্জীবিত রাখতে জেলার বিভিন্ন এলাকায় নির্মিত হয়েছে ভাস্কর্য ও স্মৃতিফলক। এছাড়া প্রতিটি এলাকায় ছড়িয়ে আছে বধ্যভূমি। চাঁদপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ ও বধ্যভূমি নিয়ে লিখেছেন আমাদের প্রতিনিধি
আল ইমরান শোভন
  ০২ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০
মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করে এই নদীতেই লাশ ফেলা হতো -যাযাদি

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চাঁদপুরে পাক হানাদার বাহিনী এবং এ দেশীয় রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী অগণিত মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করে। মহান মুক্তিযুদ্ধের ৪৯ বছর অতিক্রান্ত হতে চললেও চাঁদপুরে স্মৃতিবিজড়িত 'বধ্যভূমি' সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এমনকি চাঁদপুর জেলায় কতটি 'বধ্যভূমি' রয়েছে তারও সঠিক কোনো পরিসংখ্যান কিংবা হিসাব পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে জানা গেছে, চাঁদপুর জেলায় অন্তত ১৯টি 'বধ্যভূমি'র সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব বধ্যভূমিতে পাকসেনারা রাজাকারদের সহযোগিতায় বাঙালি মুক্তিকামী মানুষকে গুলি চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।

চাঁদপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এমএ ওয়াদুদ জানান, জেলার বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণে সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে এগুলো আস্তে আস্তে বেদখল ও স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।

বাগাদী গণহত্যা :১৯৭১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর নানুপুর স্স্নুইসগেট, ইসলামপুর, গাছতলা, পশ্চিম সকদী মাদ্রাসা, নানুপুর চৌরাস্তা এবং বাগড়া ব্রিজ পর্যন্ত গ্রামগুলোতে আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানি সেনারা স্বাধীনতা পক্ষের লোকজনদের গুলি চালিয়ে হত্যা করে এবং দুইজনকে আগুনে পুড়িয়ে মারে। এ হত্যাকান্ডে ১৮ জন শহীদ হন।

দাসাদী ও শিলন্দিয়া গণহত্যা : চাঁদপুর হানাদারমুক্ত হওয়ার দুই দিন আগে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবুরহাট বাজার সংলগ্ন দাসাদী এবং শিলন্দিয়া গ্রামে পাক হানাদার ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা মিলে স্বাধীনতার পক্ষের ১৪ জন মানুষকে হত্যা করে।

ফরিদগঞ্জ গণহত্যা-১ : শাশিয়ালী, কামালপুর ও গাজীপুরের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর ও ফরিদগঞ্জে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একত্রে ফরিদগঞ্জ উপজেলার মুন্সিরহাট, শোলস্না, আইটপাড়া ও সাচনমেঘ এলাকায় ব্যাপক লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করে গণহত্যায় মেতে উঠে। তারা স্থানীয় শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের সহায়তায় তাম্রশাসন গ্রামের আবদুর রহমান বৈদ্য ও ডা. নুর ইসলাম, মালদাহ গ্রামের রুহুল আমিন, শোলস্না গ্রামের ভুবনেশ্বর পাল এবং আইটপাড়া গ্রামের রামেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী, মিসেস চক্রবর্তী, আবুল হাসেম, ইয়াকুব ঢালী, নুর ইসলাম, নুর মোহাম্মদ, হাফেজ মিজি, জহিরুল হক, ইদ্রিস মিয়া প্রমুখকে হত্যা করে। গণহত্যার পর লাশ পথে-প্রান্তরে ফেলে রেখে চলে যায়। পরে তাদের লাশ আত্মীয়স্বজনরা স্ব স্ব পারিবারিক কবরস্থানে দাফন ও হিন্দুদের লাশ শ্মশানে সৎকার করেন।

ফরিদগঞ্জ গণহত্যা-২ : ভাটিয়ালপুর, চির্কা চাঁদপুর, ধানুয়া, প্রত্যাশী, শোভান ও টুবগী এলাকায় বসতঘর পুড়ে দেয়ার পাশাপাশি পাক হানাদার অনেককে গুলি করে হত্যা করেছে। প্রত্যাশা গ্রামের আবদুল অদুদ খান, হাবিব উলস্নাহ গাজী, হাসমতী বেগম, আবদুল আজিজ খান, ফজল গাজী, ছেরাজল হক গাজী, ধানুয়া গ্রামের আবদুর রহমান গাজী, আবদুল খালেক, আক্তার হোসেন, শোভান গ্রামের মঈনুদ্দিন খান, আবু তাহের ও আবদুল হাসিম মিজি, চাঁদপুর গ্রামের ইদ্রিস আলী মোলস্না, মুরাদ মিয়া চৌকিদার এবং চরকুমিরা গ্রামের মতি রাজা ভূইয়া পাক হানাদার বাহিনীর গণহত্যার শিকার হন।

কাদরা গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাক হানাদার বাহিনী শাহরাস্তি থানার কাদরা গ্রামে হত্যাকান্ড চালায়। এ হত্যাকান্ডে প্রাক্তন আইজিপি হোসেন আহমদের আপন ভাই হাসান আহমদসহ আশপাশের এলাকার হিন্দু-মুসলিম মিলিয়ে ২৫ জন শহীদ হন।

আহমদ নগর গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ১৩ জুলাই রাতের বেলা পাক হানাদার চাঁদপুর সদর উপজেলার ফতেপুর গ্রামের আবুল হাসেম পাটওয়ারীর বাড়ি ঘেরাও করে। হানাদারেরা আবুল হাসেম পাটওয়ারীসহ তার পরিবারের ৫ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

সাচার গণহত্যা : কচুয়া উপজেলার সাচার বাজার এলাকায় পাক হানাদার প্রাক্তন মেম্বার প্রাণ বলস্নভ পোদ্দারের বাড়িতে আক্রমণ চালিয়ে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ওই এলাকার কান্দিরপাড় গ্রামের সোনা মিয়া টেঁটা, বলস্নম নিয়ে হানাদারদের প্রতিহত করার চেষ্টা করলে তাকেও হত্যা করা হয়। এ সময় তারা পালু পোদ্দার ও চৈতন্য পোদ্দারের ৭ বছরের শিশুকে হত্যা করে।

গৃদকালিন্দিয়া গণহত্যা : ১৯৭১ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়নের গৃদকালিন্দিয়া গ্রামের শিক্ষাবিদ আইয়ুব আলী খানকে হত্যা করার জন্য কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার ও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খলিল নোয়াখালীর টেকনিক্যাল স্কুলে অবস্থানরত একজন মেজরের নেতৃত্বে এক কোম্পানির হানাদার বাহিনীকে রাতের বেলা গৃদকালিন্দিয়া গ্রামে নিয়ে আসে এবং আইয়ুব আলী খানের বাড়িতে হানা দেয়। ওই বাড়ির ঘুমন্ত লোকজনদের ঘুম থেকে তুলে এনে উঠানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারের মাধ্যমে হত্যা করে এবং সমস্ত বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।

বড়কুল গণহত্যা :১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা বড়কুল গ্রামে অতর্কিত গুলিবর্ষণ করে এবং বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এতে প্রায় ৪৫ জন গ্রামবাসী নিহত হন। এটি নৃশংস গণহত্যা।

বড়স্টেশন বধ্যভূমি : চাঁদপুর শহরের বড়স্টেশন এলাকার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীতে হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষকে ধরে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করে তাদের লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হতো। বড়স্টেশনে পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে ৭/৮টি নির্যাতন কক্ষ ছিল। পাকবাহিনী ব্যাপক হত্যাকান্ড চালায় বড়স্টেশন এলাকায়।

রায়শ্রী গণহত্যা :রায়শ্রী গ্রামের ৪ জন অধিবাসীকে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার অভিযোগে বাড়ি থেকে ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পাক হানাদার ওই গ্রামের মো. ফজলুর রহমান, শ্রীবাস চন্দ্র মজুমদার ও তার পরিবারের দু'জন সদস্যসহ তিনজনকে হত্যা করে।

কাসিমপুর গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ১২ মে কাসিমপুর গ্রামে অর্ধশতাধিক মানুষকে বিনা অপরাধে বাঙালি হওয়ার কারণে পাক হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। তারা গ্রামের বসতঘর জ্বালিয়ে দেয়। তারা যুবতী নারীদের জড়ো করে একটি ঘরে এবং দলবেঁধে ধর্ষণ করে গুলি করে হত্যা করে।

দত্রা গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ১৫ জুলাই ফরিদগঞ্জ উপজেলার গুপ্টি ইউনিয়নের খাজুরিয়া বাজার পাক হানাদার পুড়িয়ে দিয়ে দত্রা গ্রামের দীঘির পাড়ের বাড়িতে ৪ জনকে গুলি করে হত্যা করে এবং বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়।

চরভাগল গণহত্যা :ফরিদগঞ্জ উপজেলার গোবিন্দপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের চরভাগল গ্রামের বেশ কয়েকজন মানুষকে পাক হানাদার ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে।

ছোটসুন্দর হত্যাকান্ড : ১৯৭১ সালের ১০ আগস্ট পাক হানাদার ছোট সুন্দর বাজার ও পার্শ্ববর্তী তালুকদার বাড়িতে হামলা চালিয়ে বহু নিরপরাধ নর-নারীকে বিনা কারণে হত্যা করে। সেদিন শহীদ হন সামছুল হক তালুকদার (কালু), প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন (আনু), আসলাম খান, বাজারে আসা একজন ক্রেতা, ব্যবসায়ী ওহাব মিয়া, সেকান্দর সরদার, আবদুল ওয়াদুদ ছৈয়াল, বেনু লাল শীল, আবদুল খালেক পাটওয়ারী এবং আরও অজ্ঞাত ৭ জন।

রঘুনাথপুর গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর রঘুনাথপুর বাজারে সাপ্তাহিক হাটবারে পাক হানাদার বাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় অর্ধশত মানুষকে গুলি চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।

লাওকরা গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ২৩ অক্টোবর পাক সেনারা লাওকরা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়েন। এ যুদ্ধে বাঙালি মুক্তিসেনা মো. জহির হোসেন ও মো. ইলিয়াছ হোসেন শহীদ হন। যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট পদমর্যাদার অফিসারসহ ২৫ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।

রহিমানগর গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ৪ জুলাই পাক সেনারা রহিমানগর এলাকায় আক্রমণ চালায়। তারা মো. জুনাব আলী, মো. কাশিম আলী মাল, মো. আবদুল মজিদ, কালী প্রসন্ন রায়, যোগেশ চন্দ্র সরকার, তারক চন্দ্র দে, মহেন্দ্র চন্দ্র ধোপীকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে।

রসুলপুর ও এনায়েতনগর গণহত্যা : ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের শেষদিকে পাক হানাদার বাহিনী লঞ্চযোগে এনায়েতনগর এসে উঠে। তারা গ্রামের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং অনেক নারী-পুরুষকে গুলি করে হত্যা করে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে