শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অবহেলায় মুক্তিযুদ্ধের আট স্মৃতিস্তম্ভ

মহান মুক্তিযুদ্ধে কুমিলস্না সদরসহ বিভিন্ন উপজেলার চেনা-অচেনা অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উজ্জীবিত রাখতে জেলার বিভিন্ন এলাকায় নির্মিত হয়েছে ভাস্কর্য ও স্মৃতিফলক। এছাড়া প্রতিটি এলাকায় ছড়িয়ে আছে বধ্যভূমি। চাঁদপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ ও বধ্যভূমি নিয়ে লিখেছেন আমাদের প্রতিনিধি
আল ইমরান শোভন
  ০২ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০
চাঁদপুরের বড় স্টেশন এলাকায় শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ 'রক্তঝরা'

মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে চাঁদপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিসৌধ। চাঁদপুর শহরের বড় স্টেশনে 'রক্তধারা', লেকেরপাড় এলাকায় 'অঙ্গীকার', ট্রাক রোডে 'কালাম-খালেক-সুশীল-শংকর স্মৃতিসৌধ', হাজীগঞ্জে 'নাসিরকোর্ট শহীদ স্মৃতিসৌধ', মতলবে 'দীপ্ত বাংলা', মতলব উত্তরে 'চান্দ্রাকান্দি স্মৃতিসৌধ', ফরিদগঞ্জে 'স্মৃতিসৌধ ১৯৭১' এবং চাঁদপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে নির্মিত 'স্মৃতিসৌধ'। চাঁদপুর জেলায় মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্বরূপ আটটি 'স্মৃতিস্তম্ভ' নির্মাণ করা হয়েছে।

অঙ্গীকার : চাঁদপুর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে ১৯৮৯ সালে তৈরি করা হয় চাঁদপুর জেলার এই অঙ্গীকার স্মৃতিসৌধটি। এটির স্থপতি হচ্ছেন অপরাজেয় বাংলার শিল্পী প্রফেসর সৈয়দ আবদুলস্নাহ খালিদ। মূলত তখনকার সময়ের চাঁদপুর জেলা প্রশাসক এসএম শামছুল আলমের প্রচেষ্টায় এই স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়। এটি চাঁদপুর জেলার মুক্তিযোদ্ধা সড়কের পাশের লেকে অবস্থিত। এটির উদ্বোধন করেন সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

স্মৃতিসৌধটির নকশা করেন অপরাজেয় বাংলার শিল্পী প্রফেসর সৈয়দ আবদুলস্নাহ খালিদ। এতে একটি হাত ও অস্ত্রের নকশা করা হয়েছে। এটি একটি লেকের মাঝখানে নির্মাণ করা হয়েছে। মূল সড়ক থেকে লেকের ওপর দিয়ে স্মৃতিসৌধটিতে যেতে সরল রাস্তা রয়েছে।

একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ স্বাধীন করার লক্ষ্যে অঙ্গীকারের প্রতীক হিসেবে এই স্মৃতিসৌধটি তৈরি করা হয়েছে। স্মৃতিসৌধটির হাত এবং হাত দিয়ে অস্ত্র ধরে ওপরে তুলে মুক্তিযুদ্ধে অঙ্গীকারের প্রতিচ্ছবি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। যার মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করা এবং রক্ষার অঙ্গীকার হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

রক্তধারা : রক্তধারা স্মৃতিসৌধ হলো বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে তৈরি করা একটি স্থাপনা বা স্মৃতিসৌধ। মুক্তিযুদ্ধে চাঁদপুরের অনেক স্বাধীনতাকামী গণহত্যার শিকার হন। তাদের স্মরণে ২০১১ সালে নির্মিত হয় এই স্মৃতিসৌধটি। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চাঁদপুর জেলার পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনায়, চাঁদপুর পুরানবাজার এবং চাঁদপুর বড় স্টেশনে কয়েকটি নির্যাতনকেন্দ্র বা টর্চার শেল তৈরি করে। যেগুলোতে চাঁদপুর জেলার স্বাধীনতাকামী মানুষদের ধরে নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন ও অত্যাচার করত। তারা স্বাধীনতাকামী নারী-পুরুষকে হাত-পা বেঁধে জীবন্ত এবং মৃত মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর স্রোতে ফেলে দিত। রাজাকাররা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীদের এই নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালাতে সাহায্য করে। এই হত্যাযজ্ঞে যারা শহীদ হন, তাদের স্মরণেই ২০১১ সালে এই রক্তধারা স্মৃতিসৌধটি তৈরি করা হয়।

পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়ার মিলনস্থল চাঁদপুর বড় স্টেশনের মোলহেডে বধ্যভূমিতে অবস্থান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ 'রক্তধারা'। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর ২০১১ সালে স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তরুণ প্রজন্মের দাবিতে প্রশাসনের উদ্যোগে নির্মিত হয় 'রক্তধারা'। একাত্তরের মুক্তিকামী বাঙালিকে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হতো এই বধ্যভূমিতে। তাদের স্মরণে স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়, যার নাম রাখা হয় রক্তধারা। রক্তধারার স্থপতি চঞ্চল কর্মকার। এই স্মৃতিসৌধটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর এর নামফলক সংস্কার করেন মাহমুদুল হাসান খান।

রক্তধারা এক স্তম্ভবিশিষ্ট। এতে তিনটি রক্তের ফোঁটার প্রতিকৃতি দিয়ে বোঝানো হয়েছে রক্তের ধারা। টেরাকোটার মুর?্যালে আঁকা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণসহ মুক্তিযুদ্ধের কয়েকটি ঘটনাবলীর চিত্র।

কালাম-খালেক-সুশীল-শংকর স্মৃতিসৌধ : মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথমদিকে ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীকে চাঁদপুরে প্রবেশে বাধা দেওয়ার উদ্দেশে স্থানীয় ট্রাক রোডের পোদ্দার বাড়িতে শক্তিশালী বোমা বানাতে গিয়ে দুর্ঘটনাবশত বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলে কালাম, খালেক, সুশীল ও শংকর নিহত হন। হাসপাতালে সুশীল মারা যায়। তারাই চাঁদপুরের প্রথম শহীদ। চাঁদপুর জেলা প্রশাসন ও জেলা পরিষদের উদ্যোগে ট্রাক রোডে তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে একটি স্মৃতিসৌধ ১৯৯৭ সালে নির্মিত হয়। পরবর্তীতে ২০০২ সালে এটি পুনঃনির্মিত হয়।

নাসিরকোর্ট শহীদ স্মৃতিসৌধ : মুক্তিযুদ্ধে হাজীগঞ্জ থানার বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা এমদাদুল হক, জাহাঙ্গীর আলম, আবদুর রশিদ, মো. জয়নাল আবেদীন, মো. জয়নাল আবেদীন-২, মো. আবু তাহের, মো. জহিরুল ইসলাম ও মো. ইলিয়াস শহীদ হন। তাদের নাসিরকোর্টে সমাধিস্থ করা হয়। এই বীর শহীদদের এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্য শহীদের স্মরণে হাজীগঞ্জ উপজেলার রাজারগাঁও ইউনিয়নের নাসিরকোর্টে ১৯৮১ সালে স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করা হয়।

দীপ্ত বাংলা : মতলবের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে স্মৃতিসৌধ 'দীপ্ত বাংলা'র ভিত্তিপ্রস্তর মতলব জেবি পাইলট হাইস্কুল মাঠে ১৯৯৭ সালের ৪ ডিসেম্বর স্থাপন করা হয়। এটি স্থাপন করেন তৎকালীন নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, বীরবিক্রম। দীপ্ত বাংলার নকশা তৈরি করেন চাঁদপুরের কৃতী সন্তান চারুকলা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শিল্পী হাশেম খান, স্থপতি রবিউল হোসাইন ও ড. মুনতাসির মামুন। মতলবের তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অপূর্ব কুমার বিশ্বাসের উদ্যোগে, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এমএ ওয়াদুদের প্রস্তাবে এবং স্থানীয় জনসাধারণের আর্থিক সহযোগিতায় এই স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মিত হয়।

চান্দ্রাকান্দি স্মৃতিসৌধ : মতলব থানা সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তরে সাদুলস্নাপুর ইউনিয়নের চান্দ্রাকান্দি গ্রামের একই বাড়ির চারজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম, আবদুল আউয়াল, দুধ মিয়া ও শাহাজ উদ্দিনের স্মৃতি রক্ষার্থে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর চান্দ্রাকান্দি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়।

স্মৃতিসৌধ ১৯৭১ : ফরিদগঞ্জ থানা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে ফরিদগঞ্জের কৃতী সন্তান মুক্তিযুদ্ধের আট নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরীর নিজস্ব অর্থায়নে '১৯৭১' নামে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিফলকটি তৈরি করা হয়। এই ফলকটির গায়ে থানার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ নিরস্ত্র জনগণের নামের তালিকা পাথরে খোদাই করা হয়েছে। এই স্মৃতিফলক উন্মোচনকালে এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার, সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) চিত্তরঞ্জন দত্ত, জননেতা আবদুর রাজ্জাকসহ বহু শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।

জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে নির্মিত স্মৃতিসৌধ : এই স্মৃতিসৌধটি সরকারি উদ্যোগে গণপূর্ত বিভাগের মাধ্যমে ২০০৫ সালে নির্মিত হয়। এর গায়ে চাঁদপুরের বীর শহীদদের তালিকা খোদাই করে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এটি নির্মাণে এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পৃক্ততা না থাকায় তেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি, তবে জেলা কালেক্টরেট আঙিনায় এটি দৃশ্যমান রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে