শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
বক্তাবলী গণহত্যা দিবস আজ

স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি ১৩৯ শহীদ

মো. শাহাদাত হোসেন, নারায়ণগঞ্জ
  ২৯ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

আজ ২৯ নভেম্বর, বক্তাবলী গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালে আজকের এই দিনে দেশ যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, ঠিক তখনি পাকিস্থান হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় নারায়ণগঞ্জের ফতুলস্নার প্রত্যন্ত অঞ্চল বক্তাবলী পরগনার ২২টি গ্রামে। পাকহানাদার বাহিনী ২২টি গ্রামের অনেকের ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয় এবং সারিবদ্ধভাবে বস্নাশ ফায়ার করে পাখির মতো হত্যা করা হয়। এতে বক্তাবলী পরগনার ১৩৯ জন শহীদ হন। আর স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুলস্নার বক্তাবলী পরগনায় পাকহানাদার বাহিনীর গুলিতে ১৩৯ জন শহীদ এখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পাননি। এতে করে শহীদ পরিবার ও পরগনার লোকজন গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের গাফিলতির কারণে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আলোর মুখ দেখেনি বলে অভিযোগ শহীদ পরিবারের।

এদিকে গত বছর ২৯ নভেম্বর ১৩৯ জন শহীদের স্মরণে বক্তাবলীতে স্মরণসভা অনুষ্ঠানে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীম ওসমান স্বাধীনতা যুদ্ধে ১৩৯ জন শহীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু এক বছর অতিবাহিত হলেও আশ্বাস বাস্তবতার রূপ নেয়নি। এতে করে বক্তাবলী পরগনাবাসীসহ শহীদ পরিবারের সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ছাড়াও সম্প্রতি বক্তাবলীতে বহু মন্ত্রী এসেও ১৩৯ জন শহীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিসহ সরকারিভাবে বিভিন্ন সুবিধার আশ্বাস দিলেও ফলাফল শূন্য।

এদিকে বক্তাবলী দিবসটি পালনে সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। প্রতিবছরের ন্যায় এবারও বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনসহ নিহতদের পরিবারের পক্ষ হতে নানা ধরনের কর্মসূচি পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সূত্রমতে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৯ নভেম্বর বর্বরোচিত ওই হামলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ১৩৯ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান। তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি নারী কিংবা শিশু। রাজাকার, আল-বদররা জ্বালিয়ে দিয়েছিল গ্রামের পর গ্রাম। মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসে ২৯ নভেম্বর দিনটি নারায়ণগঞ্জবাসীর জন্য বেদনাবিধুর দিন। স্বাধীনতাযুদ্ধে নারায়ণগঞ্জে এক সঙ্গে এত মানুষ হত্যার ঘটনা দ্বিতীয়টি আর নেই।

আর বক্তাবলীর মানুষ শত শত মুক্তিযোদ্ধার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। সেই সঙ্গে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে পালিয়ে আসা শত শত পরিবারের আশ্রয়স্থল ছিল বক্তাবলী পরগনা। পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাত্র ১৭ দিন আগে ঘটে বক্তাবলী পরগনায় হৃদয় বিদারক হত্যাযজ্ঞ। স্বজন হারানোর ব্যথা ও কষ্ট নিয়েও শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিবছরই পালিত হয় এই দিবসটি। বক্তাবলী গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হলেও ১৩৯ জন শহীদ আজও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি।

বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরীবেষ্টিত বক্তাবলী, আলীরটেক এবং বালুরচর এলাকা মুক্তিযুদ্ধের সময় পরগনা ছিল। এখন সেটি ভেঙে তিনটি ইউনিয়ন পরিষদে রূপান্তরিত করা হয়েছে। শষ্যভান্ডারখ্যাত বক্তাবলীতে ১৯৭১ সালের ২৯ নভেম্বর ভোরে হানা দেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। কুয়াশাঘেরা ওইদিন সুবেহ সাদেক শুরু হয় পাকিস্তানিদের গুলির শব্দে। দুটি নদীর পাড়ে গানবোট নিয়ে কয়েক পস্নাটুন পাকসেনা হামলে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তাঞ্চল হিসেবে পরিচিত এই অঞ্চলে। আর এই অঞ্চলের ২২টি গ্রাম থেকে নিরীহ ১৩৯ জনকে ধরে এনে নদীর পাড়ে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে পার্শ্ববর্তী লক্ষ্ণীনগর গ্রামে স্তুপ করে রাখা হয়। কারও কারও লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় নদীতে। ২২টি গ্রামের বাড়িঘর গান পাউডার দিয়ে পুড়িয়ে দেয় পাকহানাদার বাহিনী।

'৭১ সালের ২৯ নভেম্বর ছিল প্রচন্ড শীত। সকাল থেকেই ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন ছিল পুরো এলাকা। নদীবেষ্টিত হওয়ায় কুয়াশা ছিল অনেক বেশি। ভোরের দিকে হঠাৎ করেই পাকবাহিনী গ্রামে ঢুকে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে থাকে। অপ্রস্তুত মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা জবাব দেয়। উভয়পক্ষের মধ্যে সম্মুখযুদ্ধ চলাকালীন সময় মুন্সীগঞ্জ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ব্যাটালিয়ন বক্তাবলীতে এসে এখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিলে তাদের শক্তি বৃদ্ধি পায়। পরে তারা একত্রে পাকবাহিনীর সঙ্গে প্রায় চার ঘণ্টা একটানা যুদ্ধ চালায়। সময় মুক্তিযোদ্ধারা মোক্তারকান্দি কবরস্থানের সামনে কয়েকজন রাজাকারকে ধরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।

বক্তাবলীর লক্ষ্ণীনগর এলাকার শহীদ জয়নাল আবেদীনের ছেলে মো. হেদায়েত কবির জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধা আমাদের পরগনায় অবস্থান করেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করে নিরাপদ স্থান হিসেবে আমাদের এলাকায় এসে থাকতেন। আর রাজাকারদের মাধ্যমে এমন সংবাদ পেয়ে মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময় এসে ২৯ নভেম্বর তারা এখানে হামলা চালায়। এতে করে আমার বাবা জয়নাল আবেদীনসহ ১৩৯ জন শহীদ হন। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও বক্তাবলী পরগনার ১৩৯ জন শহীদ আজও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি। এতে করে আমি খুব মর্মাহত। বর্তমান সরকার স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হওয়া সত্ত্বেও কেন শহীদরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাচ্ছেন না।

\হ

তিনি আরও বলেন, ওই সময় আমি ক্যাপ্টেন মাহফুজুর রহমানকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছি। তার বন্দুকের গুলি বহন করে এগিয়ে দিতাম। আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারিনি। এতে আমার কোনো দুঃখ নেই। কিন্তু ১৩৯ জন শহীদ রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পাক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এটাই প্রার্থনা করছি।

শহীদ পরিবারের সদস্য বাছির সরদার জানান, স্বাধীনতার ৪৯ বছরে এখনো ১৩৯ জন শহীদ রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পায়নি। অনেকে বড় বড় আশ্বাস দিলেও বাস্তবতার কোনো বালাই নেই। ২৯ নভেম্বর শুধু মিডিয়াকর্মীদের আমরা দেখতে পাই। কিন্তু সরকারিভাবে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আমি আসা করছি, আমাদের এমপি শামীম ওসমানের মাধ্যমে ১৩৯ জন শহীদ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাবেন।

বক্তাবলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী জানান, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীম ওসমান বক্তাবলীবাসীর জন্য অনেক আন্তরিক। সব সময় তিনি বক্তাবলীর কথা মাথায় রাখেন। আমাদের অঞ্চলের কথা তিনি সংসদে প্রকাশ করেছেন। পাকহানাদার বাহিনীর গুলিতে ১৩৯ জন শহীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতির জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগও করেছেন। আশা করছি, খুব শিগগিরই তার আলোর মুখ দেখতে পাব।

\হ

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধার সাবেক কমান্ডার জুলহাস মিয়া জানান, মুজিব বাহিনী প্রশিক্ষণ শেষ করে বক্তাবলী ও এর আশপাশের গ্রামে অবস্থান নেন। ওই সময় বক্তাবলী গ্রামে এক থেকে দেড়শ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদা বারিক বলেন, বক্তাবলী গণহত্যা দিবসটি জেলা-উপজেলা প্রশাসন গুরুত্ব দিয়ে পালন করে আসছে। প্রতিবছরের ন্যায় এবারও বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। আর সরকারিভাবে গণকবরটিকে বধ্যভূমি ঘোষণার দাবির সঙ্গে আমিও একমত। বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ছাড়াও বক্তাবলী পরগনাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি, ১৩৯ জন শহীদ যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পান, সেটা আমিও প্রত্যাশা করছি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে