শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখি ও তার শিল্প

হাসমত আলী দামুড়হুদা (চুয়াডাঙ্গা)
  ২৮ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০
চুয়াডাঙ্গার একটি তালগাছে শৈল্পিক বাবুই পাখির বাসা -যাযাদি

'বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই,/কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই,/ আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে/তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে।/বাবুই হাসিয়া কহে, সন্দেহ কি তাই?/কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়।/ পাকা হোক, তবু ভাই, পরেরও বাসা,/নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচাঘর, খাসা।'

এভাবেই কবি রজনীকান্ত সেন বাবুই পাখি ও শৈল্পিক বাসার বর্ণনা দিয়েছেন তার কালজয়ী 'স্বাধীনতার সুখ' কবিতায়। তবে আবহমান গ্রাম বাংলায় এখন আর আগের মতো বাবুই পাখির বাসা চোখে পড়ে না। কালের বিবর্তন ও প্রকৃতির বিপর্যয়ের কারণে আজ তা হারাতে বসেছে।

বাবুই চড়ই সদৃশ পাখি। বিশ্বে বাবুই পাখির প্রজাতির সংখ্যা ১১৭টি। তবে আমাদের দেশে তিন প্রজাতির বাবুই বাস করে। এগুলো হলো- বাংলা বাবুই, দাগী বাবুই ও দেশি বাবুই। গাছে ঝুড়ির মতো চমৎকার বাসা তৈরি করায় এ পাখির পরিচিতি জগৎজোড়া। অনেকেই একে তাঁতি পাখিও বলে থাকে।

জানা যায়, আগে গ্রামগঞ্জের তাল, নারিকেল, বাবলা ও সুপারি গাছে প্রচুর বাবুই পাখির বাসা চোখে পড়ত। এসব বাসা শুধুমাত্র শৈল্পিক নিদর্শনই ছিল না, মানুষের মনে চিন্তার খোরাক এবং উৎসাহ জোগাত। বাবুই পাখির বাসা যেমন দৃষ্টিনন্দন তেমনি মজবুত। প্রবল ঝড়ে বাতাসে টিকে থাকে। খড়ের ফালি, ধানের পাতা, তালের কচিপাতা, ঝাউ, ঘাস, আখের পাতা ও কাঁশবনের লতাপাতা দিয়ে উঁচুগাছে বাসা তৈরি করে বাবুই পাখিরা

বাবুই পাখির একটা বাসা তৈরিতে ১০/১২ দিন সময় লাগে। এপ্রিলের শেষ থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত এদের প্রজনন কাল। প্রজনন সময় ছাড়া অন্য সময় পুরুষ ও স্ত্রী পাখির গায়ে কালো কালো দাগসহ পিঠ তামাটে বর্ণের হয়। নিচের দিকে কোনো দাগ থাকে না। ঠোঁট পুরো মোচাকৃতি, লেজ চৌকা। তবে প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখির রঙ হয় গাঢ় বাদামি। বুকের উপরের দিক হয় ফ্যাকাশে।

পুরুষ বাবুই এক মৌসুমে ছয়টি পর্যন্ত বাসা তৈরি করতে পারে। প্রজনন প্রক্রিয়ায় স্ত্রী বাবুই ডিমে তা দেয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চা ফোটে। আর তিন সপ্তাহ পর বাবুই বাচ্চা ছেড়ে উড়ে যায়। বাবুই পাখির প্রজনন মৌসুম হলো পাকা ধানের মৌসুম। স্ত্রী বাবুই দুধধান সংগ্রহ করে বাচ্চাদের খাওয়ায়। বাবুই পাখির প্রধান খাদ্য তালিকায় আছে ধান, চাল, গম, পোকা-মাকড় প্রভৃতি।

এক সময় গ্রামাঞ্চলে প্রচুর তাল, নারিকেল, বাবলা গাছ ও খেজুরগাছ দেখা যেত। আর এ সব গাছে বাসা বেঁধে বসবাস করত বাবুই পাখি। বাবুই পাখির কিচিরমিচির শব্দ এবং তাদের শৈল্পিক বাসা মানুষকে আনন্দ দিত। কিন্তু বর্তমানে সেই তালগাছ যেমন আর দেখা যায় না, তেমনি দেখা মেলে না শৈল্পিক বাবুই পাখিরও। গ্রামের মাঠের ধারে, পুকুর কিংবা নদীর তীরে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছ হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে শৈল্পিক পাখি বাবুইও। এখন এসব যেন বইয়ের ছড়া এবং দাদুর কাছে শোনা গল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

দর্শনা সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আব্দুল গফুর বলেন, পরিবেশে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করা এবং বড় বড় তাল, খেজুর, নারিকেল ও বাবলা গাছ না থাকার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে কারিগর পাখি বাবুই। তাই বাবুই পাখি ও এর শৈল্পিক নিদর্শন বাসা রক্ষা করার জন্য দ্রম্নত সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে