শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আজ ঘিওরের তেরশ্রী গণহত্যা দিবস

ঘিওর (মানিকগঞ্জ) প্রতিনিধি
  ২২ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

আজ ভয়াল ২২ নভেম্বর। ঘিওরের তেরশ্রী ঐতিহাসিক গণহত্যা দিবস। পাক হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসর এবং রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যরা ১৯৭১ সালের এই দিনে বর্বরোচিত নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার তেরশ্রী গ্রামের তৎকালীন জমিদার সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায় চৌধুরীসহ ৪৩ জন গ্রামবাসীকে গুলি করে এবং বেয়নেটের আঘাতে নির্মমভাবে হত্যা করে।

হাত-পা বেঁধে শরীরে পেট্রোল ঢেলে জালিয়ে পুড়িয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জমিদার সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায় চৌধুরীকে। নিরীহ গ্রামবাসীর উপর বর্বরোচিত হামলা ও হত্যাকান্ডের কারণ জানতে চাওয়াতে ঘাতকরা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে তেরশ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমানসহ ৪৩ জন গ্রামবাসীকে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার ৪৯টি বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও নিহতদের পরিবারের খোঁজ-খবর রাখেনি কেউ। এমনকি বিচার হয়নি হত্যাকান্ডের। করোনাভাইরাসের কারণে এবার সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্ষুদ্র পরিসরে দিবসটি উদযাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, ঘিওরের তেরশ্রী গ্রামের মানুষগুলো ছিল সংস্কৃতিমনা। বাম রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল তেরশ্রী গ্রাম। মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনা ছিল জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর দোসররা টার্গেট করে এই গ্রামটিকে। গোপনে শিক্ষানুরাগী, মুক্তিযোদ্ধা, ভাষাসৈনিক, রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবীদের তালিকা প্রস্তুত করে দালালরা। নীল নকশা করে এই গ্রামটিকে ধ্বংস করার। ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর ভোর কেটে সূর্য ওঠার মুহূর্তেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও দেশীয় রাজাকার ঘিরে ফেলে তেরশ্রী গ্রামের সেনপাড়ার কালি মন্দিরটি। ২১ নভেম্বর রাতে এ দেশীয় দালালদের নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গোপনে একটি মিটিং করে তেরশ্রী গ্রামে সেনপাড়া কালিবাড়ী মাঠ প্রাঙ্গণে। তারা পরিকল্পনা করে ২২ নভেম্বর হত্যাযজ্ঞের। ঘিওর থেকে সিধুঁনগর গ্রামের মধ্য দিয়ে শতাধিক পাকিস্তানি সেনা এ দেশীয় ঘাতকদের সহযোগিতায় ভারী অস্ত্রসহ তেরশ্রী গ্রামে প্রবেশ করে। কনকনে শীতের সকাল তখন অনেকেই ঘুম থেকে উঠেনি। ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তানি সেনারা অতর্কিত হামলা চালায় গ্রামটিতে। ঘরে ঘরে জ্বালিয়ে দেয় আগুন। ঘর থেকে বের হওয়ার সুযোগ দেয়নি গ্রামবাসীকে। বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে নিরীহ গ্রামবাসীর উপর। তাদের চিৎকারে পুরো এলাকা কম্পিত হয়ে ওঠে। অপরেশনের সময় দালালরা মুখোশ পরে নেয়। মাত্র ৬ ঘণ্টার অপারেশনে ঘাতকরা একের পর এক বেয়নেট চার্জ ও গুলি করে ৪৩ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। বেলা ১২টার মধ্যে হত্যাযজ্ঞ শেষ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঘিওর সদরে চলে যায়। এই সময় পুরো এলাকা রক্তে ভেসে যায়। লাশগুলো কোনোরকম দাফন করা হয়। হত্যাযজ্ঞের পরে বহু হিন্দু পরিবার অন্যত্র চলে যায়। দেশ স্বাধীন হবার পরে কিছু মানুষ আবার ফিরে আসে তাদের বাপ-দাদার ভিটায়। তবে সেদিনের সেই নৃশংসতা কিছুতেই তারা ভুলতে পারেনি। স্বাধীনতার ৪৯ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও সেনপাড়া গ্রামের মানুষগুলো হত্যাকান্ডের বিচার পায়নি। নিহত ৪৩ জনের মধ্যে ৩০ জনের পরিচয় পাওয়া যায়। তারা হচ্ছেন- তেরশ্রী জমিদার সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায় চৌধুরী, তেরশ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমান, স্থানীয় স্কুলের দপ্তরি মাখন চন্দ্র সরকার, যাদব চন্দ্রদত্ত, তার পুত্র মাধব চন্দ্র দত্ত, সাধা চরন দত্ত, শামা লাল সুত্রধর, নিতাই চন্দ্র দাস, জগদিশ চন্দ্র দাস, সুধনা চন্দ্র দাশ, সুরেন্দ্র চন্দ্র দাশ, প্রাণ নাথ সাহা, যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, সাধন কুমার সরকার, যোগেশ দাশ, রামচরন সুত্রধর, রাধাবলস্নভ, ভোলা নাথ, জ্ঞানেন্দ্র ঘোষ, যোগেশ সুত্রধর, মো. কফিল উদ্দিন, মো. গেদা মিয়া, মো. একলাছ মিয়া, শ্যামা প্রসাদ নাগ, নারায়ণ চন্দ্র সুত্রধর, যোগেন্দ্র নাথ গোস্বামী যোগেশ চন্দ্র, গৌর চন্দ্র দাস, মো. তফিল উদ্দিন, তাজ উদ্দিন, মনিন্দ্র চন্দ্র দাশ।

তেরশ্রী শহীদ স্মৃতি উদযাপন কমিটির সভাপতি ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সাবেক কমান্ডার আব্দুল আজিজ মিয়া জানান, '৫২-র ভাষা আন্দোলন, '৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তেরশ্রী গ্রামের কৃতিত্ব রয়েছে। মানিকগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক এ এম নাঈমুর রহমান দুর্জয় জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরে প্রায় ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে ঐতিহ্যবাহী তেরশ্রী বাজারে প্রবেশ করতেই ঘিওর-দৌলতপুর-টাঙ্গাইল আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। ৩০ ফুট উচ্চতার ২টি স্তম্ভ মূল বেদির উপর দন্ডায়মান দৃষ্টিনন্দন নকশায় নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিদিন যাত্রাপথে বিভিন্ন জেলা এবং উপজেলাসহ গ্রামীণ জনপদের মানুষ ঐতিহ্যবাহী তেরশ্রীতে এমন একটি নান্দনিক স্থাপনা দেখে মুগ্ধ হন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে