কুকুর প্রভুভক্ত প্রাণী, তবুও তাকে মুগুর দিয়ে শায়েস্তা করতে হয়; সমাজে এমন কথা প্রচলিত আছে। কিন্তু প্রচলিত এ কথার উল্টো জবাব দিয়েছে ৯ বছরের এক শিশু। তার প্রকৃত নাম ফখরুদ্দীন। তাকে সবাই ফখরা নামে ডাকে। সে টাঙ্গাইলের মধুপুর পৌরসভার কাজী পাড়ায় থাকে।
গল্প নয়, এটি বাস্তবজীবনের কাহিনী। বিখ্যাত ইংলিশ মুভি টার্জন ও মুগলির সঙ্গে তুলনীয় কুকুরের দুধ পানে বড় হওয়া বিস্ময়কর ফখরার এক অবিশ্বাস্য ঘটনা শোনালেন তার মা জমেলা বেগম। জন্মের ছয় মাসের মাথায় ফখরার মাকে ছেড়ে যান বাবা। অভাবের সংসারের ঘানি টানতে মধুপুর শহরের হাটবাজারে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ নেন জমেলা। হাটের অপরিচ্ছন্ন রাস্তার ধারেই ছেলেকে বসিয়ে রেখে কাজ শেষ করতেন। ক্ষুধায় কাঁদলে হাতের কাজ ফেলে পান করাতেন বুকের দুধ। একপর্যায়ে জমেলা খেয়াল করলেন রাস্তার পাশে বেওয়ারিশ কুকুরের সঙ্গে ফখরার ভাব জমে গেছে। তখন থেকে বুকের দুধ পানের ব্যাকুলতা সন্তানের কমতে থাকে। দুশ্চিন্তায় পড়ে যান মা। একদিন হঠাৎ দেখতে পান হাটের আবর্জনার স্তূপের আড়ালে দুই ছানার সঙ্গে কুকুরের স্তন চুষছে ফখরা। তিনি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেননি। এ কান্ড দেখে তিনি যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। পরে টেনেহিঁচড়ে সন্তানকে সরিয়ে নেন জমেলা।
এ ঘটনার পর থেকে কাজের সময়ে ফখরার ওপর কড়া নজর রাখতেন মা। কিন্তু সুযোগ পেলেই কুকুর ছুটে আসত ফখরার কাছে। আর ফখরা নির্ভয়ে পান করত কুকুরের স্তন। রাগে ক্ষোভে প্রায়ই মারধর করতেন শিশু ফখরাকে।
স্থানীয়রা জানান, ১৫ বছর বয়সে জটাবাড়ির আলীম উদ্দীনের সঙ্গে জমেলার বিয়ে হয়। তিন মেয়ের পর ফখরার জন্ম ২০১১ সালে। ফখরার বয়স যখন দেড় বছর তখন থেকে কুকুরের সঙ্গে হাঁটাচলা শুরু হয়। অবিশ্বাস্য সখ্যে রূপ নেয়। পাড়ার সব কুকুরের সঙ্গে ভাব হলেও আদুরী আর বাবুলি সর্বক্ষণের সাথি। ওদের নিয়ে মধুপুর পৌরশহর ছাড়াও গাংগাইর, রক্তিপাড়া, আশ্রা, মোটেরবাজার, গারোবাজারসহ উপজেলার হাটবাজার ও গঞ্জ চষে বেড়ায় ফখরা। দূরের রাস্তায় কুকুরের পিঠে পাড়ি দেয়। যেন ঘোড়সওয়ার। বন্ধুর মতো গড়াগড়ি, গলাগলি, কামড়াকামড়ি ও কসরত দর্শকদের মুগ্ধ করে। পাঁচ-দশ টাকা বখশিশ মেলে। তাতে কেনা হয় কলা-পাউরুটি। ভাগাভাগি করে খাওয়া। এভাবেই কলা আর পাউরুটিতে দিন কাটে কুকুরবান্ধব ফখরার।
মা জমেলা এখনো মধুপুর বাসস্ট্যান্ডের পরিচ্ছন্নতাকর্মী। তিনি জানান, ছেলেকে অনেক বুঝিয়েছেন। লাভ হয়নি। কুকুর না দেখলে উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়ে। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেয়। তাই ওকে ওর মতো করে ছেড়ে দিয়েছি।
মধুপুর বাসস্ট্যান্ডের পরিবহণ শ্রমিক নির্মল জানান, রাতে এক ডজন কুকুরের কড়া পাহারায় বাড়ি ফেরে ফখরা। মায়ের রান্না করা খাবার ভাগ করে খায়। কাকডাকা ভোরে দলবেঁধে চলে যায় বাসস্ট্যান্ডে। ফখরার তিন বোনের সবার বিয়ে হয়েছে। বড় বোন শাহেদার আক্ষেপ, কুকুরের সঙ্গে থাকা-খাওয়ায় ফখরার প্রতি প্রতিবেশীরা বিরক্ত। ঘৃণা করে।
একবার মধুপুর পৌরশহরে বেওয়ারিশ কুকুর নিধন নিয়ে লঙ্কাকান্ড বাধায় ফখরা। প্রিয় কালু ও ভুলু নিধন হয় অভিযানে। এতে ক্ষেপে যায় ফখরা। বাড়িতে অস্বাভাবিক চেঁচামেচি শুরু করে। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। পরে মায়ের পরামর্শে একদল কুকুর নিয়ে পৌর ভবনে মেয়র মাসুদ পারভেজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। মেয়রকে জানায়, বন্ধু কালু আর ভুলু কখনো মানুষ কামড়াত না। তাহলে কেন তারা নিধন হলো। মেয়র আগে থেকেই ফখরাকে চেনেন। তাই বুঝিয়ে আদর দিয়ে ফখরাকে বিদায় করেন মেয়র।
ফখরা জানায়, মেয়র তাকে খুব আদর করেন। তাকে কথা দিয়েছেন- তার বন্ধুদের আর নিধন করা হবে না। এজন্য সে খুবই খুশি।
মেয়র মাসুদ পারভেজও বিস্ময়কর এ বালকের কুকুরপ্রীতি ও কুকুরের দুধ পানে বেড়ে হওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, পৃথিবীতে অনেক অবাক কান্ড ঘটে। এটি তার অন্যতম।
পৌরশহরের পাইলট মার্কেটের দোকানি রফিকুল ইসলাম তালুকদার জানান, ফখরাকে ছোটবেলা থেকেই কুকুরের সঙ্গে বড় হতে দেখেছি। কুকুরের দুধ পান করার দৃশ্য অনেকেই দেখেছেন।
জমেলা জানান, 'একদিন ফখরা হারিয়ে যায়। টানা দুদিন পর সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় পাওয়া যায় পৌরশহরের সান্দারপট্টির জঙ্গলে। এভাবেই ফখরার বেড়ে ওঠে। সব কুকুর এখন তার খেলার সাথি, বন্ধু। আসলে কুকুরের দুধ পান করেই বড় হয়ে উঠেছে ফখরা। কুকুরের সঙ্গে খাবার না দিলে অঝোর ধারায় কাঁদে ফখরা। রাগ করে হাঁড়িপাতিল ভাঙে। অস্বাভাবিক আচরণ করে। তখন ভয় লাগে। মানুষ-কুকুরে এ মিতালি বিস্ময়কর না হলেও ফখরা মাঝেমধ্যে হিংস্র ওয়ে ওঠে। ফখরার জরুরি চিকিৎসা দরকার। কিন্তু আমরা খুবই গরিব। এক বেলা খাবারই জুটেনা। আমার বুকের মানিকের চিকিৎসা করাব কীভাবে। সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনে সহৃদয়বানদের এগিয়ে আসার আর্তি জানান মা জমেলা বেগম।