বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক গভীর হতে পাঁচ বাধা

যাযাদি ডেস্ক
  ২৫ জুলাই ২০২০, ০০:০০

পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রায় অর্ধশত বছর হতে চললেও দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি হয়নি। যদিও বুধবারের এক ফোনালাপের বরাতে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক চায় পাকিস্তান। কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের চোখে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রকাশ্য অবস্থান এবং বিচারের বিরোধিতা করায় দুই দেশের সম্পর্ক একবারে তলানিতে রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক খারাপ থেকে খারাপতর হয়েছে, এমনটিই ধারণা পাকিস্তানে নিযুক্ত সাবেক বাংলাদেশের হাইকমিশনার সোহরাব হোসেনের। তিনি বলেন, 'বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে পাকিস্তানের বিরোধিতার পর সেই অবস্থা আরও বেশি খারাপ হয়েছে।' দুদেশের মধ্যে যেটুকু সম্পর্ক আছে সেটাকে 'উপরে উপরে' বলে মনে করেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের গবেষক আফসান চৌধুরী। তার মতে, 'বাংলাদেশের সঙ্গে তো পাকিস্তানের কোনো সম্পর্কই নেই। বিশেষ করে '৭১-এর পরে এই সম্পর্ক গাঢ় হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। বিশেষ করে আমাদের প্রজন্ম যতদিন থাকবে তারা তো '৭১ এর স্মৃতি নিয়েই বেঁচে আছে। বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক ভালোও হবে না, খারাপও হবে না। সম্পর্ক ভীষণ খারাপ হওয়া থেকে একটু কম খারাপ হতে পারে, কিন্তু ভালো হবে না।' প্রশ্ন দেখা দেয় যে, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মধ্যে শীতল সম্পর্কের পেছনে কী কী ইসু্য রয়েছে? ১. ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক : বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের পথে এ দুটি দেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সম্পর্ক কেমন সেটিও বেশ প্রভাব বিস্তার করে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। একদিকে যেমন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে বলে পরিচিতি রয়েছে, ঠিক তার বিপরীতে ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র হচ্ছে পাকিস্তান। এই ত্রিমুখী সম্পর্ক বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ককেও প্রভাবিত করে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আফসান চৌধুরী বলেন, 'আমাদের যে দেশের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, যার সাথে ওঠা-বসা বেশি, অর্থাৎ ভারত, তার উপর অনেকটা নির্ভরশীল।' তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে বাংলাদেশের। আবার দুদেশের সাধারণ নদীর পানি বণ্টন নিয়ে দ্বন্দ্বও রয়েছে। তবে এগুলোর পরও ভারত ছাড়া অন্য কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা এখনো পর্যন্ত হয়নি। তিনি আরও বলেন, 'পাকিস্তানের সাথে ভারতের রাজনৈতিক সম্পর্ক। ভারতের সামনে পাকিস্তান কোনো শক্তিই না, তবে সমস্যা হচ্ছে পাকিস্তানের সাথে চীন রয়েছে।' ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক বৈরী হয়ে গেছে। চীন চেষ্টা করছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে যে ভারতবিরোধিতা রয়েছে সেটাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করা। ২. বাণিজ্য : বিশ্ব বাণিজ্যে ভারতের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব রয়েছে চীনের। আর পাকিস্তানের সমর্থনে রয়েছে চীন। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশেরও সুসম্পর্ক চলছে। এই পরিস্থিতি পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক গভীর করতে পারে কি? আফসান চৌধুরীর বক্তব্য, 'হবে না। কারণ পাকিস্তানকে আসলে আমাদের কোনো দরকার নাই। পাকিস্তানের সাথে ট্রেড হবে না। আমাদের ট্রেড স্বাভাবিকভাবেই হবে ভারতের সাথে।' তিনি বলেন, 'পাকিস্তানের সাথে বাণিজ্য নাই, পড়তে যাই না, অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্যও যাই না। তাহলে সম্পর্ক উন্নয়ন করে লাভ কী?' এ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানিবিষয়ক সম্পর্ক থাকলেও রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এসব দেশের উপর নির্ভরশীল নয়। বরং বাংলাদেশ রপ্তানি করে থাকে ইউরোপের দেশগুলোতে। ৩. বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি : বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পাকিস্তানের বিরোধিতার প্রতি সমর্থন রয়েছে। আফসান চৌধুরীর চোখে, 'এখানে পাকিস্তানের দালালি করেছে এর চেয়ে বড় পাপ আর বাংলাদেশে নাই। যে দেশকে আমরা রাজনৈতিকভাবে পাপিষ্ঠ দেশ বলে মনে করছি, অন্য সব রাজনৈতিক দল, বিএনপিকে বলছি পাকিস্তানপন্থি, জামায়াতকে বলছি পাকিস্তানপন্থি, যুদ্ধাপরাধীদের বলছি সবই তো পাকিস্তানকেন্দ্রিক। সেখানে পাকিস্তানের সাথে কিভাবে সুসম্পর্ক হবে আমাদের?' তিনি মনে করেন ইমরান খানের সাথে শেখ হাসিনার কথা হলেই সেটি সুসম্পর্ক বয়ে আনবে না। ৪. ক্ষমা প্রার্থনা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রুকসানা কিবরিয়া বলেন, বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই চেয়েছে যে পাকিস্তান তাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাক। কিন্তু পাকিস্তান সেটা কখনো করেনি। ১৯৭৪ সালে সিমলা চুক্তির পর যে আলোচনা শুরু হয়েছিল তাতে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, আর বাংলাদেশ এবং ভারত পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ফেরত পাঠানো শুরু করে। এই ঘটনার কারণেই পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে এবং দেশটির কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিল। এক ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় সবার সম্মতিতে যে চুক্তি হয়, তাতে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। চুক্তির বিবরণ অনুযায়ী, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন যে, দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশের জনগণের কাছে অনুরোধ করেছেন যেন তারা তাদের (পাকিস্তানকে) ক্ষমা করে দেন এবং অতীতের কথা ভুলে গিয়ে সামনে এগিয়ে যান। তবে বাংলাদেশ বলে যে, ওই ক্ষমা চাওয়া যথাযথ হয়নি। আফসান চৌধুরী বলেন, 'ওরা দুঃখ প্রকাশ করেছিল, ক্ষমা চায়নি। ভুট্টো দুঃখ প্রকাশ করেছিল। কারণ ওদের উদ্দেশ্য বাংলাদেশ ছিল না। এটা ছিল ইন্ডিয়া। ইন্ডিয়া বলেছিল যে তুমি অন্তত কিছু বল, তা না হলে আমরা তোমার সাথে কী করব।' ৫. আটকে পড়া পাকিস্তানি নাগরিক : বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানি বা উর্দুভাষী জনগণের সংখ্যা ৫ লাখের ওপরে, যাদের মধ্যে সাড়ে তিন লাখের বসবাস বিভিন্ন এলাকায় শরণার্থী ক্যাম্পে। যেসব পাকিস্তানি নাগরিক বাংলাদেশে আটকে পড়ে, তাদের পাকিস্তানে চলে যাওয়ার বিষয়ে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল স্বাধীনতার পর পর। কিন্তু সে বিষয়টিও বাস্তবতা পায়নি। বাংলাদেশ থেকে নিজেদের আটকে পড়া নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়নি পাকিস্তান। এ বিষয়ে রুকসানা কিবরিয়া বলেন, '১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের পর যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তাতে পাকিস্তানে একটি বিশাল মুহাজির জনগোষ্ঠী রয়েছে। বিশেষ করে করাচিতে। সেজন্য তারা আরেক দল মুহাজির জনগোষ্ঠী পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিতে উৎসাহী না।' এর পেছনে একটি রাজনৈতিক অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই শিক্ষক। পাকিস্তানে নিযুক্ত সাবেক বাংলাদেশি হাই কমিশনার সোহরাব হোসেন বলেন, দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হলে সে দুটি দেশের মধ্যে যেসব ইসু্য থাকে সেগুলোকে সামনে এনে সমাধান করতে হয়। আর এগুলো হতে হলে কূটনৈতিক আলোচনা, পদক্ষেপের দরকার হয়। যুদ্ধের বিষয়ে ক্ষমা চাওয়া, অ্যাসেট রিভিশন বা দুই দেশের সম্পদের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার মতো বিষয়গুলো সম্পর্ক উন্নয়নে বড় বাধা বলে মনে করেন তিনি। তিনি মনে করেন, পাকিস্তান যদি বাংলাদেশের সঙ্গে যেসব ইসু্য আছে সেগুলো তুলে ধরে পদক্ষেপ নেয় তাহলে সম্পর্ক উন্নয়ন হতে পারে বলে মনে করেন সাবেক এই হাইকমিশনার। 'তারা যদি আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে তাহলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন না হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না, বরং উন্নয়ন হওয়ার কথা,' তিনি বলেন। বিবিসি বাংলা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে