করোনাভাইরাসের প্রভাব প্রতিরোধে তামাকজাত দ্রব্যের সবধরনের উৎপাদন ও সরবরাহ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত মূলত আর্থিক-সংশ্লিষ্ট। এই খাতের উৎপাদন বিপণন বন্ধ থাকলে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হতো সরকার। করনাকালীন সরকারের বিভিন্ন খাতের আয় কমে গেছে। ফলে একটি নিশ্চিত আয় থেকে বঞ্চিত হতে চায় না সরকার। তাছাড়া লবিষ্ট গ্রম্নপের চাপও নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সূত্র জানায়, আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরে তামাক খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ছিল প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদন ও সরবরাহ বন্ধ থাকলে নতুন অর্থবছরে এই আয় থেকে বঞ্চিত হবে সরকার। গত অর্থবছরে এই খাত থেকে কর বাবদ সরকারের আয় হয়েছিল ২২ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়কারী যুগ্ম সচিব মো. খায়রুল আলম শেখ সিগারেটসহ সব ধরনের তামাক পণ্যের উৎপাদন, সরবরাহ বন্ধের নির্দেশনা দিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়কে দেওয়া চিঠি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বিষয়টি যায়যায়দিনকে নিশ্চিত করেছেন শিল্প সচিব মো. আবদুল হালিম।
এদিকে মন্ত্রণালয়ের বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান অবস্থায় সরকারের আয়ের খাত কমে গেছে। তাই নিশ্চিত আয় হাতছাড়া করা ঠিক হবে না বলে মন্ত্রী সরকারের শীর্ষ মহলকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন। তাছাড়া ধূমপান মানুষ ত্যাগ করবে না বলেও তিনি বুঝাতে পেরেছেন। তাই যা বন্ধ থাকলেও ধূমপায়ীরা ত্যাগ করবে না তা বন্ধ না করে আয়ের পথ খোলা রাখাই উচিত বলেও তিনি বুঝিয়েছেন।
সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ও করোনার অর্থনৈতিক ক্ষতি পোষাতে তামাকজাত দ্রব্যের ওপর সুনির্দিষ্ট করারোপের চিন্তা রয়েছে সংশ্লিষ্টদের। তাদের ভাবনা হচ্ছে, সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট বাবদ চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৪ হাজার ১০০ কোটি থেকে ৯ হাজার ৮০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বেশি রাজস্ব আয় করা। যার হার বিড়ি ও সিগারেট থেকে প্রাপ্ত বর্তমান রাজস্বের চেয়ে অন্তত ১৪ শতাংশ বেশি। এছাড়া এতে প্রায় ২০ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী ধূমপান ত্যাগে উৎসাহিত হবে বলেও তারা ধারণা করছেন।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরে তামাক কোম্পানির কাছ থেকে কর বাবদ আদায় করা হয় মোট ২২ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা। যার মধ্যে আয়কর মাত্র ৮১৬ কোটি টাকা, যা তামাক কোম্পানি পরিশোধ করেছে। বাকি ২১ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা ভোক্তা ভ্যাট হিসেবে পরিশোধ করেছে। গত অর্থবছরে তামাক কোম্পানি আয়কর বাবদ যা পরিশোধ করে তা কর বাবদ মোট আদায়কৃত করের ৩ শতাংশ।
জানা গেছে, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব তামাক কোম্পানির উৎপাদন, সরবরাহ, বিপণনে ও তামাকপাতা ক্রয়-বিক্রয় কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা ও করোনাকালে এসব ব্যবসা অব্যাহত রাখার বিশেষ অনুমতিপত্র প্রত্যাহারের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে ছিল স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ।
উলেস্নখ্য, তামাক পণ্য বলতে সব ধরনের সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, গুল, তামাকপাতা, তামাক ডাঁটা ইত্যাদিকে বোঝানো হয়ে থাকে। আর ১৯৫৬ সালের 'জরুরি পণ্য আইনে' সিগারেট এ দেশে 'জরুরি পণ্য'।
জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়কারী যুগ্ম সচিব মো. খায়রুল আলম শেখ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তামাককে কোভিড-১৯ সংক্রমণ সহায়ক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাই এর ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে বলা হয়েছে। ধূমপানের কারণে শ্বাসতন্ত্রের নানাবিধ সংক্রমণ এবং কাশিজনিত রোগ তীব্র হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একাধিক গবেষণা পর্যালোচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি জানিয়েছে, অধূমপায়ীদের তুলনায় ধূমপায়ীদের কোভিড-১৯ সংক্রমণে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এছাড়া গবেষণা দেখা গেছে, কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত ধূমপায়ীর মৃতু্যঝুঁকিও ১৪ গুণ বেশি। কোভিড-১৯ সংক্রমণ মোকাবিলায় ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাময়িকভাবে সিগারেট ও তামাকজাত পণ্য ক্রয়-বিক্রয়, সিসা বার, উন্মুক্ত স্থানে পানের পিক ফেলার মতো বিষয়গুলো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশেও কোভিড-১৯ ভয়াবহ আকার ধারণ করায় এই উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
সংশ্লিষ্টরা বললেন, করোনার ভয়ে বাঙালি রাতারাতি সিগারেট ছেড়ে দেবে, এটা বিশ্বাসযোগ্য কথা না। উৎপাদন, কেনাবেচা বন্ধ থাকলে নিষিদ্ধ পথে সিগারেট পাওয়া যাবে না, এটা ভেবে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। তখনো মাদকের মতো হাত বাড়ালেই মিলবে সিগারেট। তখন দামটা বেশি পড়বে। এতে আর্থিকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সিগারেটে অভ্যস্ত কম আয়ের মানুষ। করোনা পরিস্থিতির কারণে এমনিতেই তাদের উপার্জনের পথ বন্ধ। হাতে টাকা নেই। দাম বেশি বলেই বছরের পর বছর ধরে অভ্যস্ত সিগারেট তারা ফুঁকবেন না, এমন নয়। এ দেশ ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা মিলে রমরমা ইয়াবার ব্যবসা করছে। তারাও তখন ইয়াবার সঙ্গে সিগারেটের অবৈধ বাণিজ্যের দিকে ঝুঁকতে পারেন। চোরাইপথে তখন সিগারেট ঢুকতে পারে ভারত থেকেও। এতে সরকারই হারাবে রাজস্ব। তাই নানাদিক ভেবে বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
করোনা পরিস্থিতিতে এমনিতেই বৈশ্বিক অর্থনীতির মতো বাংলাদেশের অর্থনীতি যথেষ্ট চাপে হয়েছে এবং আগামী দিনে অনিবার্যভাবে এই চাপ বাড়বে। করোণা প্রাদুর্ভাবের ফলে দেশের বিভিন্ন এলাকায় শিল্প-কারখানা ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড অনেকটা স্থবির হয়ে রয়েছে। এতে করে প্রান্তিক পর্যায়ে অনেক লোকজন বেকার হয়ে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে নগদ অর্থ ও ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচি গ্রহণ করলেও উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সরকারের জন্য দীর্ঘদিন এটি চালিয়ে নেওয়া কষ্টকর হবে। এই অবস্থায় বিদ্যমান কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং শিল্প উৎপাদন বন্ধ করলে, তা হবে জাতীয় মারাত্মক ক্ষতি।
সামগ্রিক বিবেচনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে এ শিল্প চালু রাখা যুক্তিসঙ্গত হবে বলে শিল্প মন্ত্রণালয় মনে করে। পাশাপাশি ধূমপান ও তামাকজাতীয় পণ্য সেবনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল সময়ের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় মোটিভেশনাল কার্যক্রম গ্রহণ করবে বলে শিল্প মন্ত্রণালয় আশা প্রকাশ করছে।