মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

১৮ মিনিটের ভাষণই ২৬ মার্চের প্রেক্ষাপট

জ্যোতিষ সমাদ্দার বাবু
  ২৩ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
১৮ মিনিটের ভাষণই ২৬ মার্চের প্রেক্ষাপট

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বজ্রকণ্ঠে ১৮ মিনিটের যে আওয়াজ তুলেছিলেন ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে। তাই হয়ে গেল বাঙালির প্রথম স্বাধীনতার সোপান। তিনি বজ্রকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম... এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের শেষ আটটি শব্দই হয়ে গেল সাত কোটি বাঙালির প্রাণের ভাষা, মনের ভাষা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন বোনার ভাষা। শেষ আটটি শব্দই হয়ে গেল মুক্তিকামী বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র। এ শব্দ কয়টি অগ্নিমশাল হয়ে সারাদেশে জ্বলতে শুরু করল। তাই যখন ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে বঙ্গবন্ধু বন্দি হন তার ঠিক কিছুক্ষণ আগেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। আর বঙ্গবন্ধু বন্দি হওয়ার কারণে সারা বাংলার লাখ লাখ মানুষ ক্ষোভে দুঃখে ফেটে পড়ে। অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরীহ বাঙালিদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে তাদের হত্যা করতে শুরু করে। সারি সারি হাজার হাজার স্বজনের মৃতদেহ। আকাশে কুন্ডলী পাকিয়ে উঠছে স্থাপনা ধ্বংসের কালো ধোঁয়া। জেগে উঠল মুক্তিকামী মানুষের হৃদয়, গড়ল কঠিন প্রতিরোধ। মৃতু্যভয়কে তুচ্ছ করে 'জয় বাংলা' সেস্নাগান দিয়ে ট্যাংকের সামনে এগিয়ে গেল সাহসী বাঙালি যুবকের বুক। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের শৌর্যবীর্যের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিন ২৬ মার্চ। বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার দিন। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন স্বার্বভৌম দেশ সৃষ্টি হওয়ার দিন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে, বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে। ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ভারত উপমহাদেশ ১৯৪৮ সালের ১৪ আগস্ট ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। আবার পাকিস্তানের ভেতর ২টি অঙ্গরাজ্যের জন্ম হয়, একটি পূর্ব পাকিস্তান অপরটি পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান সংখ্যাগুরু হওয়া সত্ত্বেও এখানকার জনগণ সব সময় অধিকার বঞ্চিত হতে শুরু করে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে দাবিয়ে রাখার জন্য প্রথমেই ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রম্নয়ারি আঘাত হানে আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা ভাষার ওপর। রাষ্ট্রভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দুই হবে একমাত্র পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু বাংলার দামাল ছেলেরা সে সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। জীবন দিয়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করতে বাধ্য করেছিল। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। কিন্তু আজ আমরা কি সেই স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারছি! না পারছি না, কেননা কিছু স্বার্থান্বেষী মহল এখনো দেশের সম্পদ লুট করে বিদেশে পাচার করছে। একশ্রেণির লুটেরা দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে অধিক মুনাফা লুট করছে। তারা এমনই শক্তিশালী সিন্ডিকেট যে তারা সরকারের কোনো ঘোষণাই মানছে না। এত শক্তি দেখানোর সাহস পায় কোথা থেকে। স্বাধীনতার পর, বাংলাদেশ অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতি মুক্ত একটি সুন্দর সমাজ গঠিত হয়নি। আমরা শুধু মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি কিন্তু সেটা ধারণ করে এগিয়ে যেতে পারছি না। আমাদের আশা ও বিশ্বাস প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শক্ত হাতে দুর্নীতি দমন করে বাঙালি জাতিকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা উপহার দিবেন।

১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শেষ যে ভাষণ দিয়েছিলেন তার কিছুটাও যদি বাস্তবায়িত হতো বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বহু আগেই প্রতিষ্ঠা লাভ করত। আজকের লেখায় সেই ভাষণের কিছুটা উদ্ধৃত করতে চাই।

'শিক্ষিত সমাজকে আমি অনুরোধ করব আমরা কতজন শতকরা শিক্ষিত লোক? আমরা শতকরা ২০ জন শিক্ষিত লোক। তার মধ্যে সত্যিকার অর্থে আমরা শতকরা পাঁচজন শিক্ষিত। শিক্ষিতদের কাছে আমার একটা প্রশ্ন আমি যে এই দুর্নীতির কথা বললাম, আমার কৃষক দুর্নীতিবাজ? না। আমার শ্রমিক? না। তাহলে ঘুষ খায় কারা? বস্নাকমার্কেটিং করে কারা? বিদেশি এজেন্ট হয় কারা? বিদেশে টাকা চালান দেয় কারা? হোর্ড করে কারা? এই আমরা, যারা শতকরা ৫ জন শিক্ষিত। এই আমাদের মধ্যেই ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ। আমাদের চরিত্রের সংশোধন করতে হবে আত্মশুদ্ধি করতে হবে। দুর্নীতিবাজ এই শতকরা ৫ জনের মধ্যে এর বাইরে নয়। শিক্ষিত সমাজকে একটা কথা বলব, আপনাদের চরিত্রের পরিবর্তন হয়নি। একজন কৃষক যখন আসে খালি গায়ে লুঙ্গি পরে আমরা বলব, এই বেটা কোত্থেকে আইছিস, বাইরে বয়, বাইরে বয়। একজন শ্রমিক যদি আসে বলি, এখানে দাঁড়া। এই রিকশাওয়ালা, ঐভাবে বলিস না। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কথা বলে। তুচ্ছ করে। এর পরিবর্তন করতে হবে। আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনা দেয় ঐ গরিব কৃষক। আপনার মাইনা দেয় ঐ গরিব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ঐ টাকায়। আমরা গাড়ি চড়ি ঐ টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন, ইজ্জত করে কথা বলুন। ওরাই মালিক ওদের দ্বারাই আপনার সংসার চলে। সরকারি কর্মচারীদের বলি, মনে রেখ এটা স্বাধীন দেশ। এটা ব্রিটিশের কলোনি নয়। পাকিস্তানের কলোনি নয়। যে লোককে দেখবে তার চেহারাটা তোমার বাবার মতো, তোমার ভাইয়ের মতো, ওরই পরিশ্রমের পয়সা, ওরাই সম্মান বেশি পাবে। কারণ ওরা নিজে কামাই করে খায়। একটা কথা আমি জিজ্ঞাসা করি কিছু মনে করবেন না, আমাদের লেখাপড়া শিখিয়েছে কে? আমার বাপ-মা, আমরা বলি বাপ-মা। লেখাপড়া শিখিয়েছে কে? ডাক্তারি পাস করায় কে? ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করায় কে? সায়েন্স পাস করায় কে? বৈজ্ঞানিক করে কে? অফিসার করে কে, কার টাকায়? এ সবই জনগণের টাকায়।' তিনি ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে আঘাত করে সমাজকে সুন্দর করতে চেয়েছিলেন। আমরা জাতির জনকের কথা স্মরণ করে জাতিকে এগিয়ে নিতে চাই। শুধু মুখে মুখে নয় যদি অন্তর দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসি তবে তার কথাগুলো আমাদের অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে তবেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তব রূপ পাবে। আমরা প্রকৃত স্বাধীন দেশের নাগরিক হতে পারব।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে