ছয় বছর পর আবার যশোর সরকারি এমএম (মাইকেল মধুসূদন) কলেজে ফিরলো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ছয় বছর পর একুশে ফেব্রম্নয়ারির প্রথম প্রহরে যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজে অবস্থিত শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্যে দিয়ে ফের কেন্দ্রীয় মিনারের স্বীকৃতি ফিরে পেল। এদিন রাত ১২টা ১ মিনিটে জেলা প্রশাসনের পক্ষে জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার নূর ই আলম সিদ্দিকী, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, যশোর শিক্ষাবোর্ড, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জেলা বিএনপিসহ বিভিন্ন সামাজিক, রাজনীতিক, সাংবাদিক সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এদিন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ সমবেত হন এমএম কলেজ প্রাঙ্গণে।
কলেজ ও জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রম্নয়ারি যশোরে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয় মশিউর রহমান সর্দারের (পুটে সর্দার) বাড়ির সামনে (বর্তমান সার্কিট হাউসের সামনের মুজিব সড়কের পাশের বাড়ি)। পুটে সর্দার মুসলিম লীগ করতেন। তার বাধার কারণে পরের বছর কোতোয়ালি থানার সামনে চৌরাস্তায় মধু সুইটস হোটেলসংলগ্ন ফাঁকা স্থানে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। কিন্তু অবাঙালি পুলিশ সদস্যদের আপত্তির মুখে এই শহীদ মিনারও ভেঙে ফেলা হয়।
তখন যে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছিল সেটির আকার-আকৃতি এখনকার শহীদ মিনারের মতো ছিল না। প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে ভূমিকা রেখেছিলেন ভাষাসৈনিক ডা. জীবন রতন ধর, আলমগীর সিদ্দিকী, আফসার আহম্মেদ সিদ্দিকী প্রমুখ। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৪ সালে মাইকেল মধুসূদন কলেজের পুরনো ক্যাম্পাসে (এখন সেটি পুরাতন ছাত্রাবাস) শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। ১৯৬২ সালে খড়কি এলাকার মাইকেল মধুসূদন কলেজের নতুন ভবন প্রাঙ্গণে স্থায়ীভাবে শহীদ মিনার নির্মিত হয়।
'শহীদ মিনার থেকে সুরবিতান' নামের আজীজুল হকের একটি প্রবন্ধে উলেস্নখ করা হয়েছে, 'ষাটের দশকের গোড়ার দিকে এই শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন কলেজের অধ্যক্ষ মুহাম্মদ আব্দুল হাই ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও সংগ্রামী ছাত্রনেতা প্রয়াত আলমগীর সিদ্দিকী।' এরপর থেকে এই শহীদ মিনারকেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হিসেবে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা হতো।
কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলে ২০১৮ সালে যশোর পৌরসভার তৎকালীন মেয়র জহিরুল ইসলাম চাকলাদার রেন্টু শহরের হযরত গরীবশাহ সড়কের পাশে (এমএম কলেজ পুরানো হোস্টেলের কাছে) একটি নতুন একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। যার নাম দেয়া হয় 'কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার'। ক্ষমতাসীনরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পরিবর্তন করে দেওয়ায় গত ছয় বছর সেখানেই প্রশাসনসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেছেন। তবে বিএনপিসহ কয়েকটি বাম দল এমএম কলেজ শহীদ মিনারেই শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ অব্যাহত রেখেছিল।
গত ৫ আগস্ট'২৪ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুরনো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে। এমন প্রেক্ষাপটে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন প্রস্তুতি কমিটির' সভা অনুষ্ঠিত হয়। জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলামের সভাপতিত্বে সভায় সিদ্ধান্ত হয়, যশোরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার বলতে এমএম কলেজের শহীদ মিনারকে বোঝাবে। এই শহীদ মিনারেই এবার ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে এবার ছয় বছর পর যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজে অবস্থিত শহীদ মিনার কেন্দ্রীয় স্বীকৃতি ফিরে পেয়েছে।
একুশের প্রথম প্রহরে সরেজমিনে এম এম কলেজে দেখা গেছে, ভাষাশহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাতে হাতে ফুল, কালো ব্যাজ ধারণ করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে সমবেত হয়েছেন আপমর জনতা। একুশের প্রথম প্রহর থেকে এ শ্রদ্ধা নিবেদন শুরু হয়। হাজারো মানুষকে শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনার অভিমুখে যেতে দেখা গেছে। জিলা স্কুল মোড় থেকে এম এম কলেজের দক্ষিণগেট পর্যন্ত ছিল দীর্ঘ লাইন। সেখান থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পর্যন্ত পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য।
জানতে চাইলে বাংলাদেশের বিপস্নবী কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, 'পৌরসভা নির্মিত শহীদ মিনারে আমরা কোনোদিনই যাইনি। এমএম কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থিত শহীদ মিনারকেই আমরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার মানি। আমাদের দল বরাবরই দাবি করে আসছিল এই শহীদ মিনারেই যেন শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা হয়। সেখানে এখন পর্যন্ত আমাদের পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, বিপস্নবী ছাত্রমৈত্রী, বিপস্নবী যুবমৈত্রীসহ বিভিন্ন সংগঠন ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আসছে।'