বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ৯ বৈশাখ ১৪৩২
ভাষা আন্দোলনের ৭৩ বছর

এখনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি ভাষা সৈনিক চুন্নু মিয়া

মোবাশ্বির হাসান শিপন, বোরহানউদ্দিন (ভোলা)
  ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
এখনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি ভাষা সৈনিক চুন্নু মিয়া
এখনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি ভাষা সৈনিক চুন্নু মিয়া

ভাষা আন্দোলনের ৭৩ বছর পরও বিভিন্ন মহলের দাবি সত্ত্বেও ভোলার একমাত্র ভাষা সৈনিক রেজা-এ-করিম চৌধুরী চুন্নু মিয়ার রাষ্ট্রীয় স্মীকৃতি ও তার স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কয়েকবার আশ্বাসের পরও ওই দাবি বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। এখনও ভোলার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তার স্বীকৃতি ও স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি তুলছেন। বছর ঘুরে শহীদ দিবস আসলে দু-চার কথা হয়; তারপর এ অধ্যায় চাপা পড়ে যায়।

আনুষ্ঠানিকভাবে প্রায় ১৩ বছর আগে ভাষা সৈনিক রেজা-এ-করিম চৌধুরী চুন্নু মিয়ার স্বীকৃতি ও স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছিলেন ভোলার সচেতন মহল। ভোলার তৎকালীন জেলা প্রশাসক বেলায়েত হোসেন বরাবর চুন্নু মিয়ার স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি সম্বলিত স্মরকলিপি দেন এলাকাবাসী। কিন্তু দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাস পাওয়া গেলেও এখনও দাবি দাবির যায়গায়ই আছে। এ ভাষা সৈনিকের পুরো নাম রেজা-এ-করিম চৌধুরী চুন্নু হলেও কিন্তু চুন্নু স্যার নামে সর্বমহলে পরিচিত। তার ব্যক্তিগত ডায়রি, ভোলা জেলার ইতিহাস, বোরহানউদ্দিন থানার ইতিহাস ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, তিনি ঢাকা কলেজে অধ্যয়ন করার সময় মাত্র ২১ বছর বয়সে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন।

তার ডায়েরী থেকে জানা যায়, ১৯৫২ সালে ২১ ফেবু্রয়ারি পূর্ব পাকিস্তান সরকার অপরাহ্নে ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্র প্রতিনিধিরা পূর্বেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। চুন্নু মিয়ার ডায়রির ভাষায়, 'আমরা জানতাম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিলে গেলে নিশ্চিত গুলি হবে। তারপরও মায়ের ভাষার প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা আমাকে মিছিলে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছে। হঠাৎ মনে পড়ে আমি যদি আগামিকাল মিছিলে গিয়ে গুলিতে শহিদ হই তাহলে আমার লাশের সন্ধান হয়তো আত্মীয়রা পাবে না। এ কথা ভেবে আমি রাতে বসেই আমার পুরো নাম ঠিকানা সাদা কাগজে লিখে পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম। যাতে এই ঠিকানা অনুযায়ী আমার লাশ অন্তত: স্বজনদের কাছে পৌঁছে দিতে পারে।'

বায়ান্ন'র ২১ ফেব্রুয়ারি ভোর থেকেই ছাত্র নেতৃবৃন্দের পরামর্শ অনুযায়ী ৮-১০ জনের খন্ড মিছিল শুরু হল। তাদের কলেজের তৃতীয় ব্যাচের মিছিলে ছিলেন তিনি। মিছিল যখন কলাভবনের কাছে পৌঁছল তখন তাকেসহ অনেককে আটক করে পুলিশ। সকালে পুলিশ কোর্টে নিয়ে যায়। কোর্টে হাজির না করেই এক ঘন্টার মধ্যে তাদের কেন্দ্রিয় কারাগারে নেওয়া হলো। এক মাস কারাভোগের পর ২১ মার্চ তিনি মুক্ত হন।

১৯৭১ সালে চুন্নু মিয়া ভোলার মুক্তিযোদ্ধাদের সুসংগঠিত করে স্বাধীনতা যুদ্ধে অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় তিনি নিজেকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখেননি। একাধারে ৪ স্কুলের শিক্ষকতার পাশাপাশি শুধু গ্রাজুয়েট হয়েও আব্দুল জব্বার কলেজে শিক্ষকতা করেন। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের উপর তার লেখা বই 'অনন্য সাধন' সকলের প্রশংসা পেয়েছে কিন্তু 'খেকশিয়ালের অধ:পতন' এর পান্ডুলিপি জীবদ্দশায় প্রকাশ করে যেতে পারেননি। স্বীকৃতি ও স্মৃতি সংরক্ষণের ব্যাপারে চুন্নু মিয়ার বড় ছেলে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কবির চৌধুরী ও ছোট ছেলে সাহিত্যিক মাহাবুব-উল-আলম চৌধুরী বলেন, 'বাবার মুখে আমরা ভাষা আন্দোলনের সেই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা শুনেছি। রাষ্ট্র চাইলে ১৯৫২ সালের জেল রেকর্ড তলব করলেই ঘটনার এর সত্যতা বের হয়ে আসে। রাষ্ট্র উদ্যোগী হয়ে ভাষা সৈনিকদের পূর্নাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা উচিৎ।'

ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার কুতুবা ইউনিয়নের আব্দুল জব্বার মিয়া বাড়িতে ১৯৩১ সালে জন্মগ্রহণ করেন ভোলার একমাত্র ভাষা সৈনিক রেজা-এ-করিম চৌধুরী চুন্নু মিয়া। এ ভাষা সৈনিক ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এমপিএ (গবসনবৎ ড়ভ ঢ়ধৎষরধসবহঃ ধংংবসনষু) নির্বাচিত হন। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অধিকারী এ ব্যক্তি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান ২০০৭ সালের ২ মার্চ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে