চলতি মৌসুমে বিভিন্ন ধরনের শস্য ও ফসল আবাদে সফলতার মুখ দেখছেন দিনাজপুর এবং বগুড়া জেলার কৃষকরা। এর মধ্যে দিনাজপুরের বোচাগঞ্জে বিনা চাষে রসুন, ঘোড়াঘাটে সরকারি প্রণোদনার আওতায় ভুট্টা, বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় আলু এবং পাবনার ভাঙ্গুড়ায় সরিষার বাম্পার ফলন কৃষকের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো বিস্তারিত খবর-
বোচাগঞ্জ (দিনাজপুর) প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলার ৬নং-রনগাও ইউনিয়নের ধনঞ্জয়পুর গ্রামের কৃষক নুর শাহ আলম ইউটিউব দেখে বিনা চাষে সাড়ে ৪ বিঘা জমিতে রসুন আবাদ করে কৃষকদের তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। রসুন হচ্ছে একটি মসলা জাতীয় ফসল। মাছ, মাংস, শাক, সবজি প্রতিটি রান্নার স্বাদ বাড়াতে রসুনের বিকল্প নেই। সারা বছর প্রতিটি পরিবারে রসুনের ব্যাপক চাহিদা থাকে। বর্তমান সময়ে রসুন একটি অর্থকরি ফসল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
এ বিষয়ে কৃষক নুর আলম শাহ বলেন, প্রতি বছর ধান, আলু, ভূট্টা ও সরিষা আবাদ করে অর্থনৈতিকভাবে তিনি তেমন সুবিধা করতে পারেননি। কি চাষ করলে অর্থনৈতিকভাবে সফলতা পাওয়া যাবে এমন চিন্তা থেকে ইউটিউবে সার্চ দিয়ে বিনা চাষে রসুন আবাদের ভিডিও দেখে রসুন চাষে উদ্বুদ্ধ হন। এরপর তিনি নাটোর জেলার এক বন্ধুর কাছ থেকে চার বিঘা জমির জন্য ১২ মণ বীজ নিয়ে প্রথমবারের মত বিনা চাষে রসুন আবাদ শুরু করেন।
তিনি বলেন, 'যখন আমি রসুন লাগাই তখন গ্রামের অনেকেই আমাকে পাগল বলেছিল। মোটামোটি ১মাস পর যখন রসুন গাছ বের হয় তখন মানুষ অবাক হয়েছে এবং তারা আমার প্রশংসা করে বলেছে রসুন হবে। আমি আশা করছি এই রসুনের আবাদ থেকে ভালো লাভবান হবো।'
উপজেলা কৃষি অফিসার নয়ন সাহা বলেন, 'উপজেলার সাদা মহল বস্নকে নুর শাহ আলম নামে একজন কৃষক প্রথম বারেরমত বিনা চাষে সাড়ে ৪বিঘা জমিতে রসুন আবাদ করেছেন। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের পক্ষ থেকে তাকে কারিগরি পরামর্শ প্রদানসহ সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করে আসছি।'
ঘোড়াঘাট (দিনাজপুর) প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে ধান, গম, আলুসহ অন্যান্য ফসলের তুলনায় ভুট্টা চাষ লাভজনক হওয়া রেকর্ড পরিমান জমিতে ভুট্টা চাষ করা হয়েছে। এছাড়াও ভুট্টা চাষে কৃষকদের আগ্রহী করতে সরকারি প্রণোদনের আওতায় ৮শ' বিঘা জমিতে কেএমএইচবি-৪১০ জাতের ভুট্টা চাষ করা হয়েছে।
জানা গেছে, ঘোড়াঘাট পৌরসভাসহ উপজেলার চারটি ইউনিয়নের চলতি মৌসুমে ১ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ করা হয়েছে। এ মৌসুমে কাবেরী ৫৪, আলাস্কা, দূর্জয়, পালোয়ান, সিনজেনটা ৭৭২০-সহ বিভিন্ন জাতের ভুট্টা চাষ করা হয়েছে। এ পরিমান জমি থেকে ২২ হাজার ১৩৬ মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন উপজেলা কৃষি বিভাগ।
উপজেলার বলগাড়ী গ্রামের কৃষক আনোয়ার হোসেন জানান, এ উপজেলায় অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিগুলোতে চাষ করা হয়েছে আগাম জাতের ভুট্টা। চাহিদার সঙ্গে বাজার মূল্য বেশি ও অধিক লাভ হওয়ায় এবার বোরো ধানের জমিতেও জাতের ভুট্টা করা হয়েছে।
উপজেলার বুলাকীপুর ইউনিয়নের কুলান্দপুর গ্রামের কৃষক আইনুল হক বলেন, অন্যান্য ফসলের তুলনায় ভুট্টা চাষ লাভজনক হওয়ায় এ বছর ১৫ বিঘা জমিতে চাষ করেছেন। ভুট্টা বিক্রি ছাড়াও গাছ জ্বালালি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এছাড়াও যে সব জমিতে এক সময় রোরো চাষ করা হতো, সেখানে কৃষকরা ভুট্টা চাষ করছেন।
উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মো. রফিকুজ্জামান জানান, ভুট্টা থেকে মাছ ও মুরগির খাদ্য উৎপাদন এবং গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় এটি লাভজনক। তাই কৃষকদের মধ্যে ভুট্টা চাষের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের দেওয়া হয়েছে বিনামুল্যের সার ও বীজ।
দুপচাঁচিয়া (বগুড়া) প্রতিনিধি জানান, বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় আলু তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। আর এ আলু তুলতে সময়মত পুরুষ দিনমজুর না পাওয়ায় নিম্নবিত্ত পরিবারের নারীদের দিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ আলুর বিনিময়ে ক্ষেত হতে আলু তুলে নিচ্ছেন তারা।
উপজেলা কৃষি অফিসার জানিয়েছে, এবার দুপচাঁচিয়ায় ৫হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে আলু রোপণ করেছেন চাষিরা। ইতিমধ্যে আগাম জাতের আলু চাষিরা ক্ষেত হতে তুলেছেন। এখন ফাটাপাকড়ি, বটপাকড়ি ও উথলীজাতের আলু তোলা হচ্ছে। আলু বিঘা প্রতি প্রকারভেদে প্রায় ৬০মণ হতে ৮০মণ পর্যন্ত উৎপাদন হচ্ছে।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, আলু ও সরিষার ক্ষেত আছে এমন জমি ব্যতিত অন্য পতিত জমিতে তারা ইতিমধ্যে বোরো ধান রোপণ করেছেন। এখন আলু ও সরিষা ক্ষেত হতে ঘরে তুলতে ব্যস্ত তারা। কিন্তু এই মূহুর্তে পুরুষ দিনমজুর পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে তারা নারীদের দিয়ে আলু তুলে নিচ্ছেন।
উপজেলার দুবড়া গ্রামের আলু চাষি শ্যাম চন্দ্র দাস, দেবখন্ড গ্রামের আলু চাষি আব্দুল মান্নান জানান, যত আগে আলু ঘরে তুলতে পারবেন তত আগে ওই জমিতে বোরো ধান রোপণ করা যাবে। কিন্তু এসময়ে পুরুষ দিনমজুর তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে নারীদের দিয়ে ক্ষেত হতে আলু তুলছেন। একেক জন নারীকে আলু তোলার জন্য ১৫ কেজি থেকে ১৬ কেজি করে আলু দিতে হচ্ছে। তবে বেশির ভাগ আলু চাষিদের অভিযোগ বর্তমানে আলুর যে দাম, তাতে তারা খুব একটা লাভের মুখ দেখতে পাবেন না।
অপরদিকে, আলু তুলতে এক একজন প্রতি নারীকে ২৫০ টাকা হতে ৩০০ টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক দিয়ে থাকেন তারা। তবে পুরুষ দিনমজুরদের পারিশ্রমিক তুলনামূলক বেশি।
আলু তুলতে আসা নারী সিরাতন বিবি ও সাহেরা বেওয়া জানান, তাদের বসত বাড়ি ছাড়া জমা-জমি নেই। তাই সাংসারিক কাজের পাশাপাশি ৭ দিন হতে ১০দিন পর্যন্ত আলু চাষিদের আলু ক্ষেত হতে তুলে দিয়ে যে আলু পায় তা দিয়েই তাদের প্রায় ছয় মাসের আলুর চাহিদা মিটে যায়।
ভাঙ্গুড়া (পাবনা) প্রতিনিধি জানান, ঘন কুয়াশার চাঁদর মুড়ি দিয়ে এসেছিল শীত। তীব্র শীতে শত বাঁধা উপেক্ষা করে কৃষকেরা বুকভরা আশা নিয়ে এ বছর আবাদ করেছে সরিষা। পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার প্রত্যেকটি মাঠে গেলেই চোঁখে পড়ে অবারিত সরিষার ক্ষেত। যেদিকে দুই চোখ যায় শুধু পাকা হলুদের সমারোহ। আবার কিছু জমির সরিষা তুলে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে কৃষক। এ বছর কৃষক সরিষার আবাদ করেছে প্রাণ খুলে। অল্পদিনের আবাদে কৃষকদের বেশি একটা খরচ হয় না বলে তারা সরিষার আবাদ করে থাকে। আমন ধান ওঠার পর পর কৃষকেরা জমি চাষ করে অথবা অনেকেই ধানের জমিতে চাষ ছাড়াই ছিটিয়ে সরিষার আবাদ করে থাকে।
উপজেলার খানমরিচ ইউনিয়নের পুকুরপাড় গ্রামের কৃষক আব্দুল সালাম ফকির গত বছর সাড়ে ১০বিঘা জমিতে সরিষার আবাদ করেছিল। ফলন ভালো হয়েছিল তাই এ বছর প্রায়১২ বিঘা জমিতে সে সরিষার আবাদ করেছে। কিছু জমির সরিষা পাক ধরে হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। আবার কিছু জমির সরিষা তুলে জমির মাঝখানেই মাড়াই করছে। যদি আবহাওয়ার ভালো থাকে তাহলে কৃষকরা বুকভরা আশা বেঁধেছে নিজ নিজ চাহিদা মেটানোর পর বিক্রি করে লাভবান হবার।
ভাঙ্গুড়া উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ঘনো কুয়াশা ও প্রচন্ড শীত থাকলেও সরিষার ফলন ভালো হয়েছে। এছাড়া এ উপজেলার মাটি সরিষার আবাদের জন্য বিশেষ উপযোগী। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও ইউনিয়ন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাবৃন্দ মাঠ র্পযায়ে সরিষা চাষিদের যথাযথ পরামর্শ ও সহযোগিতা করায় সরিষার আবাদ সফল হয়েছে। চলতি মৌসুমে ৬ হাজার ৬৬০ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছে। এ বছর ৬টি ইউনিয়নে ১০ হাজার ১০০ মে.টন সরিষা উৎপাদন হবে বলে কৃষি বিভাগ জানিয়েছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শারমিন জাহান জানান, বিগত বছরের তুলনায় চলতি মৌসুমে ভাঙ্গুড়ার ৬টি ইউনিয়নে সর্বাধিক উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন সরিষা গ্রামে ইতোমধ্য সরিষা ওঠানো প্রায় শেষের দিকে। স্থানীয় কৃষি বিভাগ থেকে মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের ঘরে সরিষা তোলা-মাড়াই এবং সংরক্ষণে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।