আমতলী ও বেতাগীতে সেতু ভেঙে নদীতে

যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, দুর্ভোগে এলাকাবাসী

প্রকাশ | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

স্বদেশ ডেস্ক
বরগুনার আমতলী ও বেতাগী উপজেলায় সেতু ভেঙে নদীতে পড়ে গেছে। এর ফলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন এলাকাবাসী। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত- আমতলী (বরগুনা) প্রতিনিধি জানান, ব্যাটারীচালিত অটোগাড়ির চাপে ১৮ বছরেই ভেঙে গেছে দুই কোটি টাকার আয়রণ সেতু। ভোগান্তিতে পড়েছে আমতলী উপজেলার চাওড়া ও হলদিয়া ইউনিয়নের অন্তত ৩০ হাজার মানুষ। স্থানীয়দের অভিযোগ ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম মৃধার অনিয়মের কারনে অল্প দিনের মধ্যেই ভেঙে পরেছে। দ্রম্নত ঠিকাদারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা। ঘটনাটি ঘটেছে গত সোমবার রাতে আমতলী উপজেলার চন্দ্রা আউয়াল নগর এলাকায়। মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মুহাম্মদ আশরাফুল আলম ও উপজেলা প্রকৌশলী ইদ্রিস আলী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। জানা গেছে, আমতলী উপজেলা প্রকৌশলী অধিদপ্তর ২০০৭-০৮ অর্ধ বছরে প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে উপজেলার চাওড়া ও হলদিয়া ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত চাওড়া নদীর উপর চন্দ্রা আউয়াল নগর এলাকায় আয়রণ সেতু নির্মাণের দরপত্র আহবান করে। ওই সেতুর নির্মাণ কাজ পায় তৎকালিন হলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি শহীদুল ইসলাম মৃধা। অভিযোগ রয়েছে সেতু নির্মাণকালে ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম মৃধা প্রভাবখাটিয়ে দায়সারা কাজ করেছেন। নিম্নমানের ভীম ও অ্যাঙ্গল দেওয়ায় নির্মাণের পাঁচ বছরের মাথায় সেতুর মাঝের ভীম নড়বড়ে হয়ে যায়। গত ১৩ বছর ধরে ওই নড়বড়ে সেতু দিয়ে হলদিয়া ইউনিয়ন ও চাওড়াসহ উপজেলার অন্তত ত্রিশ হাজার মানুষ চলাচল করে আসছেন। সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে দুইজন যাত্রী নিয়ে একটি ব্যাটারীচালিত অটোগাড়ি পাড় হচ্ছিল। ওই সময় সেতুর দুই তৃতীয়াংশ ভেঙে নদীতে পড়ে যায়। অটোগাড়িসহ যাত্রীরা নদীতে পড়ে গেলে গাড়িসহ তাদের উদ্ধার করে। উলেস্নখ্য, গত বছর ২২ জুন একই খালে একই ঠিকাদার নির্মিত হলদিয়াহাট সেতুর উপরে ১৬ জন বরযাত্রী নিয়ে মাইক্রোবাস পাড়াপাড়ের সময় সেতু ভেঙে নদীতে পড়ে যায়। ওই সময় ১০ জন যাত্রী নিহত হয়। কিন্তু প্রকৌশলী বিভাগ ও প্রশাসন ঠিকাদারের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। সোমবার রাতে আবার একই ঠিকাদারের নির্মিত চন্দ্রা আউয়ালনগর সেতু ব্যাটারীচালিত অটোগাড়ির চাপে ভেঙে পরেছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, চাওড়া ইউনিয়ন পাড়ের সেতুর দুই তৃতীয়াংশ ভেঙে নদীতে পড়েছে। হলদিয়া ইউনিয়নের অংশ দাঁড়িয়ে আছে। স্থানীয় নাশির হাওলাদার বলেন, 'রাতে ডাকাডাকির শব্দ শুনে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি সেতু ভেঙে অটোগাড়ী নদীতে পড়ে গেছে। পরে অটোগাড়ি ও যাত্রীদের কিনারে তুলে আনি। সেতুটি নির্মাণকালেই ঠিকাদার অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছে। ফলে অল্প দিনের মধ্যেই সেতু নড়বড়ে হয়ে যায়। এ সেতুতে কয়েকবার মেরামত করেছে কিন্তু কাজে আসেনি। ১৮ বছরের মাথায় প্রায় দুই কোটি টাকার সেতু এভাবে ভেঙে যাবে তা মেনে নেওয়া যায় না।' আহত মিরাজ সিপাহী বলেন, 'গাড়িটি সেতুর মাঝ বরাবর আসামাত্রই ভেঙে নদীতে পড়ে যাই। কিন্তু কারো কোন ক্ষতি হয়নি।' ঠিকাদার শহীদুল ইসলাম মৃধার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। কেননা গত ৫ আগস্ট থেকে তিনি এলাকা ছাড়া। আমতলী উপজেলা প্রকৌশলী ইদ্রিস আলী বলেন, 'খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ওই সেতুটি ঝুঁকিপুর্ণ ছিল। আগেই গাড়ি পাড়াপাড়ে সকর্তীকরণ নোটিশ এবং পিলার গেড়ে দেওয়া ছিল।' আমতলী ইউএনও মুহাম্মদ আশরাফুল আলম বলেন, খবর পেয়ে উপজেলা প্রকৌশলীকে নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।' বরগুনা জেলা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান বলেন, সেতু নির্মাণ কালেই ঠিকাদার অনিয়ম করেছেন। ফলে অল্প দিনের মধ্যেই সেতু ঝুঁকিপুর্ণ হয়ে যায়। গত বছর ওই সেতুটি পরিত্যাক্ত ঘোষণা করে সতর্কীকরণ নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয়রা তা না মেনে সেতুতে গাড়ি নিয়ে ওঠায় এমন অবস্থা হয়েছে। তারপরও তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বেতাগী (বরগুনা) প্রতিনিধি জানান, বরগুনার বেতাগী উপজেলার বেড়েরধন নদীর ওপর হোসনাবাদ-ডোমরাবাদ সেতুটি ভেঙে পড়ার ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও নির্মাণ করা হয়নি নতুন সেতু। এতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে দুই উপজেলার মানুষকে। দ্রম্নত সেতু নির্মানের দাবি এলাকাবাসীর। জানা গেছে, ২০০৬ সালে ডামরাবাদ-জলিশা সংযোগ সেতুটি নির্মাণ করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। সেতুটির পশ্চিম তীরে পাশের বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলার হোসনাবাদ এবং পূর্ব তীরে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার ডোমরাবাদ। নির্মাণের পর থেকে সেতুটি দিয়ে প্রতিদিন বেতাগী উপজেলার হোসনাবাদ, জলিশা এবং ওপারের ডোমরাবাদ, উত্তর আমড়াগাছিয়া ও মধ্য আমড়াগাছি এলাকার অন্তত হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করে আসছিল, কিন্তু ২০২০ সালের ২১ জানুয়ারি রাতে একটি মালবোঝাই ট্রলারের ধাক্কায় সেতুটি ভেঙে পড়ে নদীতে। স্থানীয় সূত্র জানায়, ভেঙে পড়ার পর থেকে যাতায়াতে দুই উপজেলার মানুষ গত ৫ বছর ধরে চরম ভোগান্তির শিকার। বিশেষ করে এতে নদী পারাপারে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী ও কৃষকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে। এ ছাড়া জরুরি রোগী থাকলে অবস্থা চরম আকার ধারণ করে। অনেক পথ ঘুরিয়ে হাসপাতালে আনা-নেওয়া করতে হয়। বিকল্প ব্যবস্থার অভাবে পথচারীদের চার-পাঁচ কিলোমিটার পথ ঘুরে গন্তব্যে পৌঁছতে হয়। সরেজমিনে দেখা যায়, বেড়েরধন নদীর পূর্ব ও পশ্চিম তীরের সেতুর ভাঙা অংশ এখনও নদীতে পড়ে আছে। ফলে সেতু ভেঙে যাওয়ার পর থেকে এ পথে যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে। স্থানীয়রা জানায়, নদীর ওপর সেতু না থাকায় দুই উপজেলার যোগাযোগ, শিক্ষার্থীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষকেই যাতায়াতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামের গুরুতর অসুস্থ কিংবা মুমূর্ষু কোনো রোগীকে জরুরিভাবে হাসপাতালে নিতে গেলে আট থেকে ১০ কিলোমিটার পথ বেশি ঘুরে আসতে হয়। অথচ সেতুটি চলাচলের উপযোগী হলে অনেক সহজেই এবং দ্রম্নত রোগী নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছা সম্ভব। বেতাগী উপজেলার হোসনাবাদ গ্রামের কৃষক আলী হোসেন বলেন, 'সুবীদখালী বাজার এখান থেকে কাছাকাছি হওয়ার পরও যোগাযোগব্যবস্থার অভাবে আমাদের উৎপাদিত ধান, সবজি ও অন্যান্য ফসল সময়মতো বাজারে নিতে পারছি না। ফলে ন্যায্যমূল্য থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি।' সেতু সংলগ্ন ডোকলাখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফিরোজ আলম বলেন, ভাঙা সেতুর কারণে বিদ্যালয়ে দিন দিন শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ওই পারের অনেক শিক্ষার্থী আসা-যাওয়া করতে পারছে না। প্রথম দিকে শিক্ষার্থীরা খেয়া নৌকায় নদী পারাপার হলেও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় তারা নিয়মিত স্কুলে আসে না। উপজেলার হোসনাবাদ ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ভারপ্রাপ্ত আলতাফ হোসেন ফরাজী বলেন, মালবোঝাই ট্রলারের ধাক্কায় সেতুটির পশ্চিম অংশ দুমড়েমুচড়ে নদীতে পড়ে যায়। সেই থেকে সেতুটি ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানোর পরও এটি সংস্কারের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। উপজেলার প্রকৌশলী শেখ তৌফিক আজীজ বলেন, 'সেতুটি দুই উপজেলার সীমানায় হলেও যেহেতু এর আগে মির্জাগঞ্জ প্রকৌশল বিভাগ সেতুটি নির্মাণ করে। ফলে এটি এখন নির্মাণ করতে হলে মির্জাগঞ্জ প্রকৌশল বিভাগকেই টেন্ডার প্রক্রিয়ায় নিয়ে মানুষের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে দ্রম্নত কাজ সম্পন্ন করতে হবে। তবে তারা কোনো সহযোগিতা চাইলে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করব।' মির্জাগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী চন্দন কুমার চক্রবর্তী বলেন, 'ইতোমধ্যে উপজেলার ডোমরাবাদ এলাকায় ভেঙে যাওয়া সেতুর স্থানে নতুন সেতু নির্মাণ করতে মাটি পরীক্ষা করা হয়েছে। যত দ্রম্নত সম্ভব টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু করার চেষ্টা করছি।'