বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১০ বৈশাখ ১৪৩২
দাম ও ফলন ভালো পাওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি

চলতি মৌসুমে সরিষার আবাদে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রমের আশা

স্বদেশ ডেস্ক
  ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
চলতি মৌসুমে সরিষার আবাদে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রমের আশা
চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও বরিশালের বাবুগঞ্জে বাম্পার ফলন হওয়া সরিষা ক্ষেত -যাযাদি

চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে গতবারের গতবারের চাইতে দ্বিগুন সরিষার আবাদ করা হয়েছে। সে হিসেবে এবারো এই উপজেলা সরিষা আবাদে শীর্ষে থাকতে পারে বলে মনে করছে স্থানীয় কৃষি বিভাগ। অন্যদিকে, টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতেও চলতি মৌসুমে সরিষার আবাদ বেড়েছে। ফলনও ভালো। তাই কৃষকদের মুখে হাসি ফুটেছে। এছাড়া বরিশালের বাবুগঞ্জে ৭শ' মেট্রিক টনের বেশি সরিষা উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। সব মিলিয়ে এবার সরিষা চাষ কৃষকদের জন্য আশির্বাদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। প্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্যে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্ট-

হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলা আবারো সরিষা আবাদে শীর্ষ স্থান দখল করতে যাচ্ছে। গত মৌসুমের চাইতে এবার দ্বিগুন আবাদ হয়েছে। এর আগের বছর শীর্ষে থাকলেও গত বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা বন্যার কারণে তা সম্ভব হয়নি। তবে চলতি বছর কৃষি অফিসের উদ্বুদ্ধ আর বিনামূল্যে সরিষা ও সার বিতরণে এবার বাম্পার ফলন হয়েছে সরিষার। যদিও ফতেপুর, উত্তর মাদার্শা, দক্ষিণ মাদার্শা, শিকারপুর ইউনিয়নের কয়েকটি বস্নকে কয়েকমাস আগের বন্যার পানিতে বার বার চাষাবাদকৃত জমি পস্নাবিত হওয়ায় ফলন কম হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে উপজেলার উত্তর দিকে এবার বাম্পার ফলন হয়েছে।

আমন ও বোরো চাষের মধ্যবর্তী সময়, বিনামূল্যে সরিষা ও সারের সহযোগিতা পাওয়ায় সরিষা চাষিদের খরচ কম হওয়া ও ফলন ভাল হওয়ায় কৃষকদের মুখে হাসি ফুটেছে। কৃষকদের আমন ধানে অতিরিক্ত খরচ হলেও একরকম বিনা খরচের মাধ্যমে সরিষা চাষের মাধ্যমে তা কাটিয়ে উঠতে পারবেন।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ফতেপুর, গুমানমর্দ্দন, ছিপাতলী, উত্তর মাদার্শা, দক্ষিণ মাদার্শা, ফরহাদাবাদ, ধলই, মির্জাপুর, শিকারপুর, বুড়িশ্চর, গড়দুয়ারা, মেখল, বুড়িশ্চর, চিকনদন্ডী, পৌরসভা, হাটহাজারী উপজেলাধীন চসিক ১ নং দক্ষিণ পাহাড়তলীতে মোট ৯০০ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে মির্জাপুর ইউনিয়ন সর্বোচ্চ ২৩৫ হেক্টর ও বন্যা কবলিত বুড়িশ্চর ইউনিয়নে সর্বনিম্ন ৫ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ করা হয়েছে। এছাড়া ফরহাদাবাদ ইউনিয়নে ১৭৮, ধলই ১৪৪, ফতেপুর ৬২, পৌরসভা ৪১, গুমানমর্দ্দন ৩৭, ছিপাতলী ৩৫, মেখল ২৬, ১নং দক্ষিণ পাহাড়তলী ২৬, নাঙ্গলমোড়া ২৪, গড়দুয়ারা ২২, চিকনদন্ডী ২০, দক্ষিণ মাদার্শা ১৭, উত্তর মাদার্শা ১৬, শিকারপুর ১২ হেক্টর। ১৪ ইউনিয়ন, একটি পৌরসভা ও চসিক এলাকার দুই হাজার আটশতের অধিক কৃষক সরিষা আবাদ করেছেন। চাষাবাদে লাভ দেখে কৃষকরা ঝুঁকছেন সরিষা চাষে।

এ বছর বিনা ৪, ৯ এবং বারি ১৪, ১৭ ও ১৮ জাতের সরিষা আবাদ হয়েছে। তবে বারি ১৪ ও বারি ১৮ জাতের বাম্পার ফলন হয়েছে। আবাদকৃত জমি থেকে ১ হাজার ৮০ টন সরিষা পাওয়া যাবে। যা থেকে ৩ লাখ ২৪ হাজার লিটারের অধিক তেল উৎপাদনে সম্ভাবনা। যার বাজার মূল্য ৭ কোটি টাকারও বেশি। কৃষকরা তাদের ভোজ্য তেলের চাহিদা মিটিয়ে বাজারজাত করলে উপজেলাবাসীর অনেক পরিবারের ভোজ্য তেলের চাহিদা মেটাতে পারবেন।

হাটহাজারীর উত্তরে পশ্চিম ধলই কাটিরহাট এলাকার সরিষা চাষি প্রকাশ বড়ুয়া বলেন, এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। নিজের ও অন্যের মিলে সাত কানি (দুইশ' আশি শতক) জমিতে সরিষা করেছেন। কানি প্রতি ৫০০ কেজি সরিষা পাবেন বলে আশা প্রকাশ করছেন। যা গতবারের চাইতে পঞ্চাশ থেকে একশ কেজি বেশি।

এবারের মৌসুমে রেকর্ড পরিমান সরিষা আবাদ হলেও কোথাও দেখা মেলেনি মধু সংগ্রহের কোনো মৌবক্স। অতীতের কোন অভিজ্ঞতা না থাকায় কোন কৃষকই মৌবক্সের ব্যবস্থা করতে পারেননি। এদিকে কৃষি অফিস থেকেও এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

দক্ষিণ মাদার্শা ইউনিয়নের মধ্যম মাদার্শা এলাকার নেহালপুর বিলে সরিষা চাষ করা দুই বন্ধু কৃষক জাকের হোসেন ও রাশেদুল আলম জানান, প্রায় দশ কানির মত সরিষা আবাদ করেছেন। নিজেদের পরিবারের ভোজ্য তেলের চাহিদা মিটিয়ে কিছু বাজারজাত করার আশা তাদের। পাশাপাশি সরিষা ক্ষেত থেকে মধু সংগ্রহের আশায় মানিকছড়ি থেকে ছয় হাজার টাকায় পরীক্ষামূলক একটি মৌবক্স এনেছেন। যদি কোন অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীর কিংবা সরকারিভাবে সহযোগিতা পান হাটহাজারীতে রেকর্ড পরিমান মধু সংগ্রহ করতে পারবেন সরিষা চাষিরা।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন শিকদার বলেন, সরকারিভাবে কৃষকদের উন্নত জাতের আড়াই টন বীজ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রণোদনা হিসেবে দেওয়া হয়েছে সার। বন্যার কারণে দেরীতে চাষ হলেও কয়েকটি এলাকা ছাড়া বাকিগুলোয় ফলন খুবই ভালো হয়েছে। ২৩ সালে চট্টগ্রামের মধ্যে হাটহাজারী শীর্ষ অবস্থানে ছিল। এবারো ভালো রেকর্ড হবে।

ধনবাড়ী (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি জানান, টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলায় এবছর সরিষার আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে। একদিকে সরিষার হলুদ ফুলে ছেয়ে গিয়েছে দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ, অন্যদিকে ফুল থেকে সরিষার ছেঁই গজিয়ে বাম্পার ফলনের আভাস দিচ্ছে কিছু কিছু জমিতে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চলতি মৌসুমে এ উপজেলায় সরিষার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগ ও কৃষকরা।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত বছর এ উপজেলায় ২হাজার ২শ' হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়েছিল। এবার ২ হাজার ৪শ' হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এরমধ্যে ২ হাজার ৪০৫ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে এবার ২০৫ হেক্টর বেশি। এর মধ্যে ৩৬ মেট্রিক টন সরিষা উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এবছর বারি-১৪-১৭ ও বিনা-৯ জাতের সরিষা চাষ করা হয়েছে। ধান চাষ করে প্রতিবারই লোকসান গোনার কারণে কৃষকরা সরিষা আবাদে ঝুঁকে পড়েছেন। সরিষা আবাদ করে এ উপজেলায় স্বাবলম্বী হয়েছেন অনেক কৃষক।

অন্যদিকে স্থানীয় কৃষি বিভাগ সরিষা চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করতে নানাভাবে প্রণোদনা দিয়েছে। সে পরিপ্রেক্ষিতে ৫হাজার ৬শ' কৃষককে প্রতি বিঘার জন্য ১০ কেজি এমওপি সার, ১০ কেজি ডিএপি সার ও ১ কেজি করে বীজ বিনামূল্যে দিয়েছে।

হাতীবান্ধা লাভলু ও ঘোনারবন্ধ এলাকার কৃষক শামছুল হক চিন্তা মিয়া বলেন, 'সরকারীভাবে সার ও বীজ দেওয়া থেকে কৃষি অফিসারদের সার্বিক পরামর্শে সরিষার আবাদ ভালো করতে পেরেছি। বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা দেখছি। যদি দাম ভালো থাকে তাহলে আমরা কৃষকরা লাভবান হতে পারব।'

বীরতারা ইউনিয়নের দায়িত্বে থাকা উপসহকারী কৃষিকর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম জানান, কৃষিকে এগিয়ে নিতে সার্বিকভাবে মাঠ পর্যায়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।

ধনবাড়ী উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মাসুদুর রহমান জানান, উপজেলা কৃষি অফিস থেকে ও কৃষি উপ-সহকারী কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে জমির অবস্থানুযায়ী কৃষকদের সঠিক মাত্রায় সার এবং কীটনাশক দেওয়ার পরামর্শ দেওয়াসহ আবহওয়া অনূকূলে থাকায় ফলন ভালো হয়েছে।

বাবুগঞ্জ (বরিশাল) প্রতিনিধি জানান, বরিশালের বাবুগঞ্জে বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে শুধুই হলুদের সমারোহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। সরিষা ফুলের হলুদ রঙের বর্ণিল আভায় ছেয়ে গেছে গোটা ফসলের মাঠ। বাবুগঞ্জ উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নের মাঠে সরিষা ফুলের হলুদ রঙের সমারোহ লক্ষ্য করা গেছে।

চলতি মৌসুমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ না থাকায় সরিষার আবাদ লক্ষনীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবং যথাসময়ে সরিষা ঘরে তুলতে পারলে ভালো দাম পাবেন কৃষক বলে মনে করছেন বাবুগঞ্জ উপজেলার কৃষি অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, সরকারের নেওয়া বিশেষ উদ্যোগ তেল জাতীয় ফসলের আবাদ বৃদ্ধিতে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা প্রতিদিন মাঠে কৃষকদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। ফলে বাবুগঞ্জে সরিষা আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। উপজেলায় ৬টি ইউনিয়নে বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৭, বারি সরিষা-১৫, বারি সরিষা-১৮ ও বিনা-৪, বিনা-৯, নিনা-১১ জাতের সরিষা আবাদে সফলতা পাচ্ছে কৃষক। উপজেলার দেহেরগতি ইউনিয়নের রাকুদিয়া, বাহেরচর ও কেদারপুর ইউনিয়নের পশ্চিম ভূতেরদিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, মাঠজুড়ে শোভা পাচ্ছে সরিষা ক্ষেত। দূর থেকে দেখলে মনে হবে বিশাল এক হলুদের চাদরে ঢেকে আছে ফসলের মাঠ।

রাকুদিয়া গ্রামের সরিষা চাষি মিজানুর সরদার বলেন, 'আমি ১ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ করেছি। গতবারের চেয়ে এবার ফলন ভালো হয়েছে। আশাকরি সারা বছর পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বিক্রিও করতে পারব।'

চাঁদপাশা ইউনিয়নের সরিষা চাষি সাইফুল ইসলাম বলেন, 'সরিষা চাষে শ্রম ও খরচ দুই-ই কম। তাই সরিষা চাষ করেছি।'

উপজেলা কৃষি অফিস থেকে জানা যায়, চলতি মৌসুমে উপজেলায় ৪১০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। আবাদ হয়েছে ৪৮০ হেক্টর। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮০ হেক্টর জমিতে সরিষা বেশি আবাদ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে হেক্টর প্রতি ১-১.৫ টন সরিষা উৎপাদন হবে। সে হিসাবে ৭০০-৮০০ মে.টন সরিষা উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। উপজেলা কৃষি অফিসার আব্দুর রউফ বলেন, 'সরকারের নেওয়া বিশেষ উদ্যোগ তেল জাতীয় ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে কাজ করছে কৃষি বিভাগ। আমরা সাময়িক পতিত জমিতে সরিষা আবাদে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে আসছি। সরকার প্রতিবছর ভোজ্য তেল আমদনিতে ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচ করতো। কৃষি বিভাগের প্রচেষ্টায় এখন অর্ধেকে নেমে এসেছে। বাবুগঞ্জে এবার সরিষা আবাদে ৫৫০ জনকে প্রণোদনা দিয়েছি। তারা সবাই ১ কেজি করে সরিষা বীজ ও পর্যাপ্ত সার পেয়েছে। এতে ৭৩ হেক্টর জমিতে প্রণোদনার মাধ্যমে সরিষা আবাদ হয়েছে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে