বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার লেখা ইচ্ছামতী কাব্যের ৩২৯ নম্বর পৃষ্ঠায় পাবনার ইছামতী নদী দিয়ে নৌকা যোগে যাতায়াতকালে নিজ কণ্ঠে গেয়েছিলেন। অনুলিপি ছিল এমনটি 'জলের উপর ঝলোমলো টুকরো আলোর রাশি/ ঢেউয়ে ঢেউয়ে পরীর নাচন/ হাততালি আর হাসি।' কবিতায় তিনি লিখেছেন- 'যখন যেমন মনে করি তাই হতে পাই যদি/আমি তবে এক্ষুণি হই ইচ্ছামতী নদী।'
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক স্মৃতি জড়িত এই নদীর সঙ্গে। তিনি জমিদারি দেখাশোনা করতে বজরা ভাসিয়ে পদ্মা নদী হতে ইছামতি নদীর বক্ষে প্রবেশ করতেন। ইছামতির সৌন্দর্য, ছোট ছোট ঢেউ, নদী পাড়ের ঘাসফুল-কাশফুল সবুজ-শ্যামল স্নিগ্ধ প্রকৃতি, নব বধূদের জলকেলি, শিশু-কিশোরদের দাপাদাপি সবই বজরায় বসে উপভোগ করতেন। নদীর এই রূপে-সৌন্দর্যে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিমোহিত হয়েছিলেন।
দীর্ঘদিন ধরে দখল ও দুষণের কবলে পড়ে সেই ইছামতী আজ যেন মরা খাল। সম্প্রতি অনাদরে অবহেলায় ভাগাড়ে পরিণত হওয়া ঐতিহ্যবাহী ইছামতী নদী পুনরুজ্জিবীতকরণের লক্ষ্যে মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। ১ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সেনাবাহিনীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে দ্রম্নতগতি নিয়ে প্রাণ ফেরানোর কাজ চলছে। নদীর গতিশীল কাজে জেলাবাসীর মনে নতুন করে ইছামতী নদীর অনুভূতি কাজ করছে।
পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সুধাংশু কুমার সরকার জানান, প্রকল্পের মধ্যে ১১০.১৪ কিলোমিটার নদী পুনর্খনন কাজ, শহরে ১০ কিলোমিটার রিটেনিং ওয়াল নির্মাণ, নদীর দুই পাড়ে ১০ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ, ২৩টি ব্রিজ নির্মাণ/পুনঃনির্মাণ, ইছামতির দুই তীরে ৫৬টি ঘাটলা নির্মাণ, উভয় তীরে ১০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ এবং ৪২ হাজার ৩১০টি বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ রয়েছে। এ কাজগুলোকে মোট ছয়টি স্স্নটে ভাগ করে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। গত বছরের ২৫ মে থেকে ইছামতির পুনর্খনন কাজ শুরু হয়। নদীর সাঁথিয়া উপজেলার মাধপুরের পাশে জগন্নাথপুর গ্রাম থেকে এই খনন কাজ শুরু হয়েছে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এমএস আহাদ বিল্ডার্স খনন কাজ করছে এবং তত্ত্বাবধান করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। কাজের শেষ সীমা ধরা হয়েছে ৩১ মার্চ ২০২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
তিনি আরও জানান, এ মেগা প্রকল্পের মধ্যে ২৩টি ব্রিজ নির্মাণ-পুনর্নির্মাণ কাজ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান টিসিএল বা তানভীর কনস্ট্রাকশন লিমিটেডকে দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই তারা পাবনা শহরের মধ্যে কাজ শুরু করবে। কারণ এরই মধ্যে তারা হাজীরহাটে চামড়ার গোডাউনের পাশে ক্যাম্প স্থাপন করে মালামাল রাখতে শুরু করেছে। ওদিকে নদীর দুই পাড়ে ১০ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ এবং উভয় তীরে ১০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ কাজের ডিজাইন টিম পর্যবেক্ষণ করে গেছে। সেনাবাহিনীর হাতে এরই মধ্যে খসড়া ডিজাইন চলে এসেছে। ফাইনাল কপি আসলেই আশা করা যাচ্ছে ড্রেনেজ এবং উভয় তীরে ১০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ কাজ শুরু হবে।
তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সুধাংশু কুমার সরকার আরও জানান, নদীর দুই তীরে প্রথমে ড্রেন হবে, তারপর ওয়াকওয়ে, তারপর গার্ডওয়াল বা রিটেইনিং ওয়াল। তবে নদীর তীরবাহুর স্স্নোপ অথবা স্স্নোপে বস্নকের কথা প্রকল্পের মধ্যে ছিল না। এখন নতুন করে এটি পাশ হয়েছে, অর্থাৎ পাবনাবাসীর জন্য সুসংবাদ যে, শহরের মধ্যে এই ১০ কিলোমিটার নদীর উভয় তীরে বস্নক ফেলে স্স্নোপ তৈরি করা হবে। নদীর সার্বিক স্স্নোপ ধরা হয়েছে সর্বনিম্ন ১১.৫ মিটার।
ইছামতি নদীর পাবনা সদরের গয়েশপুর, আটঘরিয়ার একদন্ত ইউনিয়নের কাজীরবাজার ও সদরের মালঞ্চি ইউনিয়নের ইসলামপুর সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, এই খনন কাজে মোট ১২৫টি ভেকু মেশিন দিয়ে সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত একটানা খনন কাজ চলছে। খনন কাজের মাটি নদীর দুইপাড়ে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। জেলা প্রশাসকের নিয়ন্ত্রিত কমিটির সিদ্ধান্তের পর মাটিগুলো উন্মুক্ত টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রি করা হবে। ইতোমধ্যে নদী খনন কাজ প্রায় অর্ধেক শেষ হয়েছে, যা পুরোপুরি খনন কাজের ২৫ শতাংশ।
ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের প্রজেক্ট ম্যানেজার সাইদুল ইসলাম জানান, শিগগিরই আরও ১৫টি ভেকু মেশিন খননকাজে যুক্ত হবে। ফলে কাজের গতি আরও বাড়বে। তারা এখন পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার খনন কাজ সম্পন্ন করেছে। জগন্নাথপুর, ভবানীপুর, শিবপুর, আতাইকুলা, সড়াভাঙ্গি, পীরপুর, কাছারপুর, মৌগ্রাম পার হয়ে বর্তমানে মালঞ্চি ইউনিয়নের ইসলামপুর পর্যন্ত কাজ অগ্রসর হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রকল্পের কাজ ২৫ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার আশা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের।
বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, শহরের মন্ডলপাড়া থেকে চরশিবরামপুর, কোষাখালী, ভোমরা কোল হয়ে রূপপুর চ্যানেলের কাজ শুরু হয়ে গেছে। মূলত এই রুটে কিছু জমি অধিগ্রহণ করা বাকি থাকায় কাজ শুরু করতে দেরি হয়েছে। সূত্র জানায়, নদীর সব জায়গায় জলা ধরা হয়েছে সর্বনিম্ন ২৫.৭ মিটার। তবে সিএস মানচিত্রে নদীর জায়গা কোথাও প্রশস্ত থাকলে সেখানে জলাও বেশি হবে।
পাউবো পাবনার আইন উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট জাকির হোসেন বলেন, ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত পাবনার আদালতে ৮৭টি মামলা করেছে নদীপাড়ের অবৈধ দখলদাররা। দ্রম্নত নিষ্পত্তির মাধ্যমে নদী উদ্ধার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।
ইছামতী উদ্ধার আন্দোলন পাবনার সভাপতি এসএম মাহবুব আলম বলেন, 'আমরা অনেক বছর ধরে নদীটি উদ্ধারে আন্দোলন করে আসছি। নদী খননসহ সার্বিক কাজ করছে সেনাবাহিনী এমন খবর আমাদের জন্য আনন্দের।'
ইছামতী নদী পুনরজ্জিবীতকরণ প্রকল্পের সার্বিক তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ২৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের ওয়ারেন্ট অফিসার সাইফুল ইসলাম বলেন, 'পুরো কাজে সম্পৃক্ত রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। আমরা ঠিকাদারের কাছ থেকে সিডিউল মোতাবেক কাজ বুঝে নিচ্ছি।'