উত্তরের প্রান্তিক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে অবদান রাখতে চলতি বছরেই বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাচ্ছে সিরাজগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল। উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদ্বার এই অঞ্চল চালুর মাধ্যমে শুধু জেলার কর্মসংস্থান নয়, আশপাশের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে। সম্পূর্ণ পরিকল্পিত অর্থনৈতিক অঞ্চলে গ্যাস ও বিদু্যতের নিরবিচ্ছিন্ন সংযোগের ফলে অল্প বিনিয়োগে অধিক মুনাফাও পাবেন উদ্যোক্তারা। ইতোমধ্যে দেশি-বিদেশি নামি-দামী বেশ কিছু উদ্যোক্তা পস্নট বরাদ্দ নিয়েছেন। আরও আগ্রহ দেখাচ্ছেন বিদেশীরা। অঞ্চলটি চালু হলে পাল্টে যাবে সিরাজগঞ্জসহ আশাপাশের জেলার অর্থনৈতিক অবস্থা।

জানা যায়, বাংলাদেশের বর্তমানে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বিভিন্ন জেলার মানুষ। নদীমাতৃক ও চিরসবুজ বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা তাদের নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে এগিয়ে রয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের বিশাল জনসংখ্যাকে বিকেন্দ্রীকরণ করার লক্ষ্যে দেশের মানচিত্রকে চার প্রদেশে ভাগ করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। সেই বিবেচনায় অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে সিরাজগঞ্জ জেলা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এরই অংশ হিসেবে সিরাজগঞ্জ জেলার যমুনা নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে উঠছে সু-বিশাল অর্থনৈতিক পয়েন্ট। সেখানে একটি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের পাশাপাশি বিসিক শিল্পপার্ক ও একটি ইপিজেড তৈরির প্রাথমিক পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

এই তিন অর্থনৈতিক এলাকায় কাজ পুরোদমে শুরু হলে সিরাজগঞ্জ জেলাসহ উত্তরবঙ্গে নতুন করে প্রায় ১০ লাখ মানুষের নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং অর্থনীতিতে আনবে বড় পরিবর্তন। চলতি বছরেই বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিরাজগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল। সরেজমিন ঘুরে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

উত্তরবঙ্গে প্রবেশের মুখে যমুনা সেতু পার হয়েই দক্ষিণে সদর উপজেলার খাসবড়শিমুল, পঞ্চসোনা, চকবয়রা এবং বেলকুচি উপজেলার বেলছুটি ও বড়বেরা খারুয়া এলাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে 'সিরাজগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল'। ১০৪২ একর জায়গায় গড়ে উঠছে এই অর্থনৈতিক অঞ্চল। উদ্যোক্তাদের দাবি, এটি বেসরকারি খাতে দেশের বৃহৎ ও গ্রীন ইকোনমিক জোন। ওই অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রায় ৪ শতাধিক কোম্পানি গড়ে তোলা সম্ভব। এখানে বড় জায়গাগুলো রাখা হয়েছে বিদেশি উদ্যোক্তাদের জন্য। সব কলকারখানা চালু হলে এখানে পাঁচ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) ঘুরে দেখাযায়, রাস্তাঘাট নির্মাণ চলছে ও প্রকল্প এলাকার পস্নট চিহ্নিতের কাজ শেষে ইতিমধ্যে দেশি-বিদেশি প্রায় ২০টি প্রতিষ্ঠান ভূমি বুঝে নিতে শুরু করেছে। কয়েকটি কারখানার ভবনের অবকাঠামো নির্মাণের কাজের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। চলতি বছরেই বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাবে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান।

সিরাজগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল লিমিটেডের (এসইজেডএল) পরিচালক শেখ মনোয়ার হোসেন বলেন, 'আমাদের ইকোনমিক জোনের প্রজেক্ট অফিস চালুর পাশাপাশি কারখানা বস্নক ও রাস্তা চিহ্নিত করে মাটি ভরাটের কাজ প্রায় ৮৫ শতাংশ শেষ। ফেইজ-১ ও ফেইজ-২ এরিয়ার মাঝে একটি সেতু তৈরিও শেষ হয়েছে। শুরু হয়েছে কারখানার বস্নক চিহ্নিত করে উদ্যোক্তাদের পস্নট বুঝিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া। মোট জমির ৬০ শতাংশ জায়গায় কারখানা তৈরির জন্য ৪০০ মতো পস্নট করা হচ্ছে। বাকি জমিতে পার্ক, বনায়ন, পর্যটন সুবিধা, হাসপাতাল, আইসিটি জোন, হাটবাজার, পুকুর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি গড়ে তোলা হবে। শ্রমিকদের জন্য থাকবে অত্যাধুনিক ডরমেটরি। আমরা আশা করছি, ২০২৫ সালেই এখানে প্রথম শিল্প প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে যাবে। আমাদের লক্ষ্য ২০৩০ সাল নাগাদ এখানে সব মিলিয়ে ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করা। ব্যক্তি মালিকানাধীন ১১টি কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে গড়ে ওঠা এই ইকোনোমিক জোনে প্রায় ৪০০টির মতো পস্নট তৈরি হচ্ছে। প্রকল্পের মাস্টার পস্নান ও সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপারস (পিডবিস্নউসি) এবং ডিটেইল ইঞ্জিনিয়ারিং পস্ন্যান করছে জাপান ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট (জেডিআই)। গ্যাস, বিদু্যৎ ও অবকাঠামোগত সুবিধার পাশাপাশি জল, স্থল এবং রেলপথে উৎপাদিত পণ্য সরবরাহের সুবিধা থাকবে এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে।

মনোয়ার হোসেন আরও বলেন, ইকোনোমিক জোনকে ঘিরে নদীবন্দর হচ্ছে, রেলওয়ের ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো (আইসিডি) কাজ প্রায় শেষ, ট্রেন লাইন আছে, যমুনার ওপর আলাদা রেল সেতু হয়েছে (উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে), ফোর লেনের রাস্তাসহ অনেকগুলো ফ্লাইওভার হয়েছে। এছাড়া এখানে যমুনা নদীর মিষ্টি পানি আছে। যমুনা নদীর পানি ওয়াটার ট্রিপমেন্ট পস্ন্যান্টে নিয়ে যাওয়া হবে, সেখান থেকে ফ্যাক্টরিতে সাপস্নাই দেওয়া হবে। কারখানায় গ্যাস সরবরাহ নিয়েও প্রস্তুতিমূলক কাজ চলছে।

সিরাজগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চলে অনেক বড় নামি দামি কোম্পানি জমি বরাদ্দ পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার, কন্টিনেন্টাল গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিজ, ডায়নামিক ড্রেজিং, নিট এশিয়া, এমকে কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, রাতুল ফ্যাব্রিক, অ্যাকটিভ কম্পোজিট মিলস, রাইজিং হোল্ডিংস, রাইজিং স্পিনিং মিলস, মেরিনা প্রপার্টিজ, টেক্সট টাউন, স্কয়ার এক্সেসরিজ এবং স্কয়ার ইলেকট্রনিক্স।

শেখ মনোয়ার হোসেন আরও বলেন, সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন রপ্তানিমুখী উদ্যোক্তাদের সব ধরণের সুবিধা নিয়েই তৈরি হয়েছে। ১০ বছরের আয়কর রেয়াত সুবিধা, শুল্কমুক্ত সুবিধা, কাষ্টমস বন্ডেড এলাকা হিসেবে ঘোষিত।

এছাড়া সামনের দিনগুলোতে শিল্পকারখানার জন্য যেখানে সেখানে জমি পাওয়া অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছে বিধায় ইকোনোমিক জোনে পরিবেশগত ও অবকাঠামো সুবিধার কারণে উদ্যোক্তারা বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছেন। শুরুর দিকে চ্যালেঞ্জিং কাজ জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করার পাশাপাশি নানা প্রশাসনিক জটিলতা কাটিয়ে ইকোনোমিক জোনের বর্তমান অগ্রগতি এখন সন্তোষজনক।