বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২

ভোলার ৫৫০ বছরের পূরাকীর্তি সংরক্ষণের দাবি

মোবাশ্বির হাসান শিপন, বোরহানউদ্দিন (ভোলা)
  ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
ভোলার ৫৫০ বছরের পূরাকীর্তি সংরক্ষণের দাবি
ভোলার বোরহানউদ্দিনে ধ্বংস হওয়ার পথে ৫৫০ বছরের পুরনো চন্দ্রদ্বীপের রাজা জয়দেব ছোট মেয়ে বিদ্যাসুন্দরী ও জামাতা গুড়িন্দার রাজবাড়ি -যাযাদি

ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলা সদর থেকে ৫-৬ কিলোমিটার দক্ষিণে সাঁচরা ইউনিয়নের পাঁচ নাম্বার ওয়ার্ডে গুড়িন্দা বাড়িতে দেখা মেলে কয়েক শতাব্দী প্রাচীন এক নান্দনিক প্রাসাদের। কালের সাক্ষি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জেলার ৫৫০ বছরের পুরোনো ভবন। এর চেয়ে পুরোনো কোন স্থাপনার ইতিহাস ভোলা জেলায় নেই। জেলা তথ্য বাতায়নেও ঐতিহাসিক পূরাকীর্তি বিভাগে এ ধরনের কোন কিছুর উলেস্নখ নেই। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই এ পূরাকীর্তি দেখতে আসছেন। ছবি তুলছেন। তৎকালীন সময়ের নির্মানশৈলী দেখে অনেকেই অবাক হচ্ছেন। এমনকি প্রকৌশলীরাও এর নির্মানশৈলী দেখে বিস্মিত হচ্ছেন।

বিভিন্ন পেশাজীবি মহল সরকারিভাবে এ পূরাকীর্তি সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন। ওই স্থাপনার বর্তমান মালিক এবং স্থানীয়রাও এর পূর্ব ইতিহাস জানেন না। গত দেড়শ বছরের ইতিহাসে ওই স্থাপনার মালিকানা সিএস,আরএস,এসএ খতিয়ানে বর্তমান মালিকানা পূর্ব-পুরুষদের নামে বলে ওই ঘরে বসবাসরতরা জানান। ধারনা করা হয় রায়তি সূত্রে ওই প্রাসাদের মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে।

বরিশাল বিভাগের ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় ৫৫০ বছর আগে চন্দ্রদ্বীপের(বর্তমান পটুয়াখালীর অংশ) রাজা জয়দেবের ছোট মেয়ে বিদ্যাসুন্দরী ও জামাতা গুড়িন্দার জন্য ওই রাজবাড়ি নির্মান করেন। রাজার জামাতা গুড়িন্দা রাজসভার মন্ত্রী ছিলেন। মন্ত্রী গুড়িন্দা ১৪৭৫ সালের দিকে বিদ্যা সুন্দরীর নামে বিশাল দিঘী খনন করেন। এলাকায় বিদ্যা সুন্দরীর দিঘী নিয়েও নানা কল্প-কাহিনী প্রচলিত আছে।(সূত্র-বরিশাল বিভাগের ইতিহাস, সিরাজ উদ্‌দীন আহমেদ,পৃষ্ঠা-১৪৯) তবে প্রফেসর মোহাম্মদ হোসেন চৌধুরীর ভোলা জেলার ইতিহাস ও এ.বি.এম. আমিনউল্যাহ্‌'র বোরহানউদ্দিন থানার ইতিহাস থেকে জানা যায়,রাজা জয়দেব তাঁর মেয়ে বিদ্যাসুন্দরীকে তাঁরই রাজ্যসভার গোয়েন্দা প্রধানের সাথে বিয়ে দেন। তাঁর মেয়ে ও জামাতার জন্য ওই রাজকীয় প্রাসাদ নির্মান করেন। রাজার জামাতা গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করার কারণে ওই বাড়ির নাম একসময় গোয়েন্দা বাড়ি ছিল। ধারণা করা হয় জমিদারি প্রথার পর কালক্রমে মানুষের মুখে মুখে ওই বাড়ির নাম গুড়িন্দা বাড়ি হয়ে যায়।

ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির দক্ষিণ ভিটায় প্রাচীন স্থাপত্যের অবস্থান। সামনের অংশে নানা ধরনের নকশা করা। অনেক অংশ দিয়ে পলেস্তারা খসে গেছে। অযত্নে দেয়ালের ভাঁজে ভাঁজে শ্যাওলা পড়ে আছে। প্রবেশ দূয়ার একটি। তবে আয়তন উচ্চতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। দূয়ারের প্রস্থ তিন ফুট আর উচ্চতা মাত্র পৌনে ছয় ফুট। ভিতরের দেয়ালে বিভিন্ন নকশা, আল্পনা। বারান্দা থেকে ভিতরের ঘরের দু'টি দরজা। আশ্চর্যের বিষয় ওই দরজা দুটি'র উচ্চতা মাত্র সাড়ে চার ফুট। দেয়াল এবং ছাদে চুন-সুরকি ব্যবহার করা হয়েছে। দেয়ালের প্রস্থ কমপক্ষে ২৫ ইঞ্চি। ছাদের প্রস্থও ১০-১১ ইঞ্চি। তবে মেঝে ক্ষয়ে গেছে। পশ্চিম দিক দিয়ে ইট সুরকির সিঁড়ি সরাসরি ছদের সাথে মিশেছে। ভবনের পিছনের দিকে মাটির সাথে ২-৩ টি সুরঙ্গ মুখ। সিঁড়িতে যে ইট ব্যবহার করা হয়েছে তা দৈর্ঘ্যে ১২ ইঞ্চি ও প্রস্থে ৬ ইঞ্চি। যে কয়টা ইট দেখা যায় সম্পূর্ন অবিকৃত। ভিতর-বাহির সব দিকের নির্মানশৈলী দেখলে ৫৫০ বছর আগে কীভাবে এ কাজ করা সম্ভব হয়েছে তা এক বিস্ময়! ওই ঘরের বাসিন্দা আ. লতিফের ভাষ্যমতে, এক সময় তাঁর দাদা আ. আজিজ, দাদার ভাই দেলোয়ার হোসেন ও ফজলে করিম একসাথে থাকতেন। তাঁদের মৃতু্যর পর তাঁর বাবা আ. কাদের ও পরবর্তী ওয়ারিশগণও বসবাস করতেন। এখন স্থান সংকুলান না হবার কারণে তিনি বাড়ির পাশে ঘর করেছেন। এখন দেলোয়ার হোসেনের নাতি ৬২ বছর বয়সী নান্নু গুড়িন্দা ওই ঘরে থাকেন। নান্নু গুড়িন্দা ও আ. লতিফ গুড়িন্দা জানান, সরকারিভাবে ঘর সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলে তাঁদের কোন আপত্তি নেই।

বোরহানউদ্দিন থানার ইতিহাস গ্রন্থের রচয়িতা এ.বি.এম আমিনউল্যাহ্‌ আক্ষেপ করে জানান, আমি এক সময় প্রাচীন এ স্থাপত্য সংরক্ষণের জন্য অনেক কাজ করেছি। এক সময় ক্লান্ত হয়ে গেছি। এখনও সময় আছে। এ পূরাকীর্তি সংরক্ষণের উদ্যোগের দাবি জানাই। প্রবীন সাংবাদিক ও সমাজকর্মী ওমর ফারুক তারেক জানালেন, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এ স্থাপনা একটি জলন্ত দলিল। ইতিহাস ঐতিহ্যের এ পূরাকীর্তি সংরক্ষণ করার সরকারি উদ্যোগ জরুরী।

বোরহানউদ্দিন উপজেলা নির্বাহী অফিসার রায়হান-উজ্জামানজানান, শিগরিই পরিদর্শনপূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে