বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২

বেতাগীর কারিকরপাড়ায় নেই খুঁট-খাট শব্দ

মো. শামীম সিকদার, বেতাগী (বরগুনা)
  ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
বেতাগীর কারিকরপাড়ায় নেই খুঁট-খাট শব্দ
বেতাগীর কারিকরপাড়ায় নেই খুঁট-খাট শব্দ

বরগুনার বেতাগী উপজেলার বিবিচিনি কারিকরপাড়ার তাঁতিরা তাদের পেশা বদলে অন্য পেশায় যোগ দিয়েছেন। এ জনপদে তাঁতশিল্পের ঐতিহ্য অন্তত দুই বছরের পুরানো। কাঁচামালের বেশি দাম ও বিক্রয়মূল্য কম হওয়ায় লাভ হত না তাঁতিদের। অর্থনৈতিক সংকট, প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব, রঙ ও সুতার ঊর্ধ্বমূল্য, ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তির জটিলতা এবং বাজারজাত সমস্যার কারণে শিল্পটি অস্তিত্ব হারিয়েছে। দুর্দিন নেমে এসেছে তাঁতনির্ভর পরিবারাগুলোয়। জীবনজীবিকার তাগিদে তারা বাধ্য হয়েছেন পারিবারিক পেশা জাত পেশা ছাড়তে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পেলে তাঁতিরা ফিরতে চায় আগের পেশায়

বিষখালী নদীর কূল ঘেঁষে গড়ে ওঠা দেশের উপকূলীয় জনপদ বরগুনার বেতাগী উপজেলা। উপজেলা সদর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে গাছ-গাছালিতে ঘেরা অপরূপ শোভার বিবিচিনি ইউনিয়নের কারিকরপাড়া গ্রাম। একসময় ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাঁতের খটাস-খটাস শব্দে জেগে থাকত পাড়াটি। সেসব এখন অতীত। নামে মাত্রই রয়েছে বিবিচিনি তাঁতিপলস্নী। অথচ এ জনপদে তাঁতশিল্পেরে ঐতিহ্য অন্তত ২শ বছরে। খাঁখাঁ রাস্তাঘাট। কোথাও কোনো জনমানবের চিহ্নমাত্র নেই। দুয়েকটি পাখির ডাকের সঙ্গে দূর থেকে সেদিনও ভেসে আসছিল বিবিচিনির কারিকরপাড়ায় গামছা বোনার খুটখাট শব্দ। পঞ্চাশোর্ধ্ব আদম আলী দক্ষ হাতে জাত পেশার কাজটি এক মনে তখনও করে যাচ্ছিলেন।

একসময় পাড়ার প্রতিটি ঘরে তাঁত দেখা যেত। হাতে চালানো তাঁতের খটাস-খটাস শব্দে মানুষ থমকে দাঁড়াত। এখানকার তাঁতে তৈরি কাপড় নারী-পুরুষ সবারই পছন্দের ছিল। শিল্পীমনা তাঁতিরা মনের মাধুরী মিশিয়ে নানা নকশা আঁকতেন। এ গ্রামের একেকজন তাঁতি মানেই একেকজন শিল্পী। তাইতো তাদের তৈরি কাপড়ের এত সুখ্যাতি। কিন্তু এখন সে জৌলুস নেই। সিডর ও আইলা তাদের সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। তারপর আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি কারিকরপাড়ার তাঁতিরা।

এখানকার তাঁতিপলস্নীতে একসময় শতাধিক পরিবার তাঁত বুনত। তাদের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই। যারা বেঁচে আছেন তাদের বেশির ভাগই পেশা বদল করে দিনমতুরি, কৃষিকাজ বা ছোটখাটো কোনো ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন। তাঁতি পরিবারের সংখ্যা নেমে এসেছে প্রায় শূন্যের কোঠায়। অবশ্য এখন হাতেবোনা গামছাই বা ব্যবহার করে কজন? এমনিতেই কদর কমেছে তাঁতেবোনা কাপড়ের। সময়ের সঙ্গে পালস্না দিতে না পেরে প্রাচীন এ হস্তশিল্পটি এখন বিলুপ্তির পথে।

সরেজমিনে গেলে জানা যায়, বর্তমানে কাঁচামালের বেশি দাম ও বিক্রয়মূল্য কম হওয়ায় লাভ পান না তাঁতিরা। অর্থনৈতিক সংকট, প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব, রঙ ও সুতার ঊর্ধ্বমূল্য, ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তির জটিলতা এবং বাজারজাত সমস্যার কারণে শিল্পটি অস্তিত্ব হারিয়েছে। দুর্দিন নেমে এসেছে তাঁতনির্ভর পরিবারাগুলোয়। জীবন জীবিকার তাগিদে তারা বাধ্য হয়েছেন জাত পেশা ছাড়তে। সময় যত এগিয়েছে এক এক করে হারিয়ে গেছে এ তাঁতিপলস্নীর তাঁতের কাহিনী। হারিয়ে গেছেন সুদক্ষ কারিগররাও। এখন শুধু তাঁতিপলস্নী নামটাই পড়ে রয়েছে হারানো গৌরবের স্মৃতি হয়ে। তাঁতি যে কয়েকজন বেঁচে আছেন সবাই বয়সের ভারে নুব্জ।

বিলুপ্তির পথে হাঁটলেও বংশপরম্পরায় এখানকার তাঁতিরা জড়িয়ে পড়েন জাত পেশায়। বেছে নেন জীবিকা অর্জনের প্রধান অবলম্বন হিসেবে। জানা যায়, তাঁতে কাপড় বুনতে পারে না এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া এখানে দুষ্কর। তাঁতি পরিবারে মেয়েদের লেখাপড়া, সংসারে সহায়তা ও অন্যান্য কাজের পাশাপাশি 'তাঁতে কাপড় বোনা' জাতিগত গুণ হিসেবে দেখা হয়। বিয়ের ক্ষেত্রেও তাঁতিসমাজে বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। ছোট থেকেই নানাভাবে শিক্ষা দিয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের তাঁতে কাপড় বুনতে পারদর্শী করে তোলা হয়।

একসময় এখানকার পণ্য এলাকার চাহিদা পূরণের পাশাপাশি অন্য এলাকায়ও সরবরাহ হতো, কিন্তু তাঁতিরা দিনদিন এ পেশা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। নেওয়া হয়নি সরকারি কোনো উদ্যোগ, দেওয়া হয়নি পৃষ্ঠপোষকতার বা তাঁতের উন্নয়নে কোনো প্রশিক্ষণ। তখন কারিকরপাড়ায় লুঙ্গি, চাদর, শাড়ি, বিছানার চাদর ও হরেক রকমের গামছা বোনা হতো। সিডরের আগেও এখানে শুধু গামছা তৈরি করা হতো। তৈরি মালামাল নিয়মতি ও বেতাগী বাজারে পাশাপাশি বরগুনাসহ পাশের জেলা ঝালকাঠি ও পটুয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি হতো।

স্থানীয়রা জানান, বর্তমানে বিদেশি পণ্য বাজার দখল করে ফেলেছে। এ কারণে পণ্যের কদর কমে যাওয়ায় বাজারেও চাহিদা অনেক কমে গেছে। সোহরাব কারিকর (৫৫) জানালেন, আগের মতো আর বাজার নেই। তাই পুরানো পেশায় ফিরতে চান না তাঁতিরা।

তাঁতিরা বলছেন, বাঁচার তাগিদে তাঁতশিল্প অনেকে পেশা হিসেবে নিলেও বর্তমানে বাজারে রঙ ও সুতার দাম যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে সে হারে তাঁতশিল্পের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর দাম বাড়েনি। ফলে ব্যবসায় মার খেয়ে এ পাড়ার তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে।

সাবেক ইউপি সদস্য তাঁতি মো. শাহজাহান বলেন, পুঁজির অভাবে অনেকেই এ শিল্পের সঙ্গে নিজেদের জড়িত রাখতে পারছেন না। বিভিন্ন সমস্যার কারণে অনেকে এ পেশায় টিকে থাকলেও সফল হচ্ছেন না। অনেকেই বসেছেন পথে। তাঁতি আছিয়া বেগম (৪০) জানান, শত দুঃখকষ্টের মাঝেও পুরানো পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যেতে না চাইলেও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে অনেকেই বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করেছেন। বর্তমানে অসম প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা হস্তচালিত তাঁতশিল্পের জন্য কঠিন পরীক্ষা। এজন্য কেবল তাদের প্রয়োজন সুষ্ঠু ও সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা, পরিকল্পনা ও সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা। আরও দরকার দেশি তাঁতবস্ত্রের মানোন্নয়ন, বিশেষ অনুদান প্রদান, পেশাগত শিক্ষা ও উন্নত প্রশিক্ষণ।

তাঁতশিল্প নিয়ে কথা হয় বেতাগী উপজেলার বিবিচিনি ইউনিয়নের তাঁতিপলস্নীর কারিগর ফোরকান বেপারীর সঙ্গে। তিনি বলেন, '২০ থেকে ২২ বছর হলো এ পেশা ছেড়েছি। দুই দশক আগেও যে টাকায় ১ বেল্ট সুতা পাওয়া যেত এখন তা কয়েক গুণ বেশি টাকায় কিনতে হয়। তা ছাড়া বেড়েছে রঙ ও অন্যান্য কাঁচামালের দাম। সে অনুপাতে লুঙ্গি ও গামছার দাম পাই না। সারা দিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পরও যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালানো দায়। তাই বাপদাদার পেশায় আর আঁকড়ে থাকতে পারিনি।'

তাদের মতো তাঁত কারিগর মৌজে আলী বেপারি, আবদুর রশীদ বেপারি, আবদুল মোতালেব, মুজিবর রহমান, নিলুফা বেগম, হাজেরা বেগমসহ অনেকেই কৃষিকাজ, চায়ের দোকান, বিদেশে যাওয়া, শ্রমিকের কাজ, রিকশা ও ভ্যান চালিয়ে কোনোমতে জীবন চালাচ্ছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে