শেরপুরের গারো পাহাড়ে ৩০ বছরেও মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব নিরসনে গড়ে ওঠেনি অভয়ারণ্য ও সোলার ফেন্সিং। ফলে পাহাড়ি গ্রামবাসী গত ২ যুগেরও অধিক সময় ধরে রয়েছেন চরম বিপাকে। থামছে না মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব। হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা যাচ্ছে মানুষ। সেই সঙ্গে মারা পড়ছে হাতিও। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ঘরবাড়ি ও ফসল। গ্রামবাসী এই দ্বন্দ্ব নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
জানা যায়, ১৯৯৬ সালে শেরপুরের ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ী ও শ্রীবরদী উপজেলার সীমান্তে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পাহাড়ি এলাকা জুড়ে থাকা ৫০ গ্রামে শুরু হয় বন্যহাতির তান্ডব। এসব পাহাড়ি গ্রামে গারো, হাজং, কোচ, বানাই বর্মন, হিন্দু মুসলিমসহ বিভিন্ন জাতিগোত্র মিলে লক্ষাধিক লোকের বসবাস। এরা সিংহভাগ শ্রমজীবী ও কৃষির উপর নির্ভরশীল।
সরেজমিনে অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৩০ বছর ধরে উপুর্যপুরি বন্যহাতির তান্ডবে পাহাড়ি গ্রামবাসীদের ঘরবাড়ি, গাছপালা, ক্ষেতের ফসল ও জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে।
গ্রামবাসী জানান, বন্যহাতির দল দিনে গভীর অরণ্যে আশ্রয় নিচ্ছে। আর সন্ধ্যা নামলেই খাদ্যের সন্ধানে নেমে আসছে লোকালয়ে। কৃষক তাদের ক্ষেতের ফসল ও জানমাল রক্ষার্থে রাত জেগে পাহাড়া দিচ্ছেন। সনাতন পদ্ধতিতে ঢাকঢোল পটকা ফুটিয়ে ও মশাল জ্বালিয়ে হাতি তাড়ানোর চেষ্টা চলছে।
কিন্তু যতই হাতি তাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে ততোই বন্য হাতির দল তেড়ে আসছে লোকালয়ে। কিছুতেই তাড়ানো যাচ্ছে না হাতি। ২ যুগেরও অধিক সময় ধরে আতঙ্কে রাত কাটছে পাহাড়ি গ্রামবাসীদের। পেটের খাবার না থাকলেও রাতে হাতি তাড়ানোর জন্য ২লিটার কেরোসিন তেল ঘরে রাখা তাদের বাধ্যতামূলক। ধান পাকার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে হাতির তান্ডব বৃদ্ধি পায়। হাতির তান্ডবে ক্ষেতের ফসল ঘরে তুলতে পারেন না তারা।
কৃষিবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বন্যহাতির তান্ডবে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে শতশত একর আবাদি জমি পতিত পরে আছে। এতে চরম বিপাকে রয়েছেন কৃষকরা। যদিও বন্যহাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মানুষের মৃতু্য ও ফসলের ক্ষতিপুরণ প্রথা প্রচলিত আছে বনবিভাগের পক্ষ থেকে।
মধুটিলা গ্রামের বাদশা মিয়াসহ গ্রামবাসীদের অভিযোগ- ফসলের ক্ষতিপুরণের টাকা পেতে যে সব ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে সেসব ঝামেলা পোহাতে চান না কৃষকরা। আবার কেউ আবেদন করলেও বছরের পর বছর ঘুরতে হয়। এছাড়া পাহাড়ি গ্রামগুলোতে এলোটম্যান্ট ও সরকারি খাস খতিয়ান ভুক্ত জমির পরিমান বেশি। তাই কাগজপত্রের জটিলতায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ভাগ্যে জুটছে না ক্ষতিপূরণের টাকা।
জানা গেছে, বনবিভাগের পক্ষ থেকে গারো পাহাড়ে মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব নিরসনে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে ২৫টি ইআরটি (এলিফেন্ট রেসপন্স টিম) গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি কমিটিতে ১০ জন করে সদস্য রয়েছেন। তারা এলাকায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি করে মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব নিরসনে কাজ করছেন। কিন্তু সরকারি সুযোগ সুবিধা না থাকায় ঝিমিয়ে পড়ে এ কমিটির কার্যক্রম।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভারতের বিশাল এলাকা জুড়ে এককালে ছিল বনভূমি। এসব বনভূমি পরিস্কার করে বিভিন্ন প্রজাতির ফসলাদি উৎপাদনের কাজ হাতে নেয় ভারত সরকার। শুধু তাই নয় বনভূমিতে ফসল উৎপাদন ও সীমান্তে কাটা তারের বেড়া নির্মাণের কারনে বন্যহাতিরদল ভারতে প্রবেশ করতে পারছে না। ফলে শেরপুর সীমান্তে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। এছাড়া গারো পাহাড়ে বন বিভাগের ২০ হাজার একর বনভূমি থাকলেও বিপুল পরিমাণের বনের জমি বেদখল ও প্রাকৃতিক বন না থাকায় বন্যহাতির আভাসস্থল সংকুচিত হয়েছে। পাশাপাশি খাদ্য সংকটে রয়েছে বন্যহাতি।
বন বিভাগ সুত্রে জানা গেছে, গারো পাহাড়ে ১২০টির মতো হাতি অবস্থান করছে। খাদ্য ভান্ডার না থাকায় চরমভাবে খাদ্য সংকটে রয়েছে বন্যহাতির দল। হাতির তান্ডব শুরু হওয়ার পর থেকেই গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে জানমাল রক্ষার্থে হাতির খাদ্যভান্ডার গড়ে তোলার পাশাপাশি গ্রামবাসীদের নিরাপত্তার জন্য সোলার ফেনসিং স্থাপনের দাবি জানানো হয় সরকারের কাছে। বিভিন্ন সময় জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে আশ্বাসও পাওয়া যায়। কিন্তু গত ৩০ বছরেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
এক অনুসন্ধানে জানা যায়, গারো পাহাড়ে গত ২ যুগেরও বেশি সময় ধরে হাতির আক্রমনে ৩৫ জন মানুষের মৃতু্য হয়েছে। আহত হয়েছে অনেকই। একই সময়ে মৃতু্য হয়েছে ৩০টি হাতিরও। শেরপুর জেলা বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সুত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বনবিভাগের পক্ষ থেকে গারো পাহাড়ে ২৫টি ইআরটি এ্যালিফেন্ট, ২০১৬ সালে গারো পাহাড়ের সীমান্তের ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার হাতি কবলিত পাহাড়ি গ্রামগুলোতে স্থাপন করা হয় সোলার ফেন্সিং (বৈদু্যতিক তারের বেড়া), যা দিয়ে হাতি আক্রান্ত হবে, কিন্তু মারা যাবে না। ১৩কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এ সোলার ফেন্সিং স্থাপন করা হয়। কিন্তু ঠিকাদার নিম্নমানের কাজ করায় নির্মাণ শেষ হতে না হতেই তা অকেজো হয়ে পড়ে। কোন কাজে আসছে না গ্রামবাসীদের।
জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেন, গারো পাহাড়ে মানুষকে যেমন থাকতে হবে, বাঁচতে হবে, বন্য হাতিকেও সুরক্ষা দিতে হবে। এজন্য হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব কমানোর পরিকল্পনা আছে। বনাঞ্চলের আশপাশের এলাকায় সরকারি খাস খতিয়ানের কিংবা বনবিভাগের জমি রয়েছে। সে কারণে সেখানে বসবাসকারীদের ক্ষতিপূরণ পেতে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।