আইনি জটিলতায় যশোরের অভয়নগরে টেকারঘাট সেতুর নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে গেছে। দুর্ভোগে পড়েছে পাশাপাশি দুই উপজেলার হাজার হাজার মানুষ। কাঠের তৈরি বিকল্প সেতু দিয়ে চলাচলে ঘটছে ছোটবড় দুর্ঘটনা।
নির্ধারিত সময়ে নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়ায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরকে (এলজিইডি) দায়ী করলেন রিটকারি ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক ইকবাল কবীর জাহিদ। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলে পুনরায় কাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন যশোর জেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আহমেদ মাহবুবুর রহমান।
জানা গেছে, অভয়নগর ও মণিরামপুর উপজেলার সীমান্তে টেকা নামে একটি নদী রয়েছে। নদীর এক পাশে অভয়নগর উপজেলার পায়রা ইউনিয়ন। অপরপাশে মণিরামপুর উপজেলার নেহালপুর ইউনিয়ন। দুই উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা ঠিক রাখতে ১৯৮০ দশকে অভয়নগরের টেকারঘাট এলাকায় একটি সেতু নির্মাণ করেছিলেন তৎকালিন সরকার। দীর্ঘদিনের পুরাতন সেই সেতু ভেঙে ২০২১ সালের ১৩ অক্টোবর একই স্থানে নতুন সেতু নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। খুলনা বিভাগীয় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ৮ কোটি ৫৫ লাখ ৭৩ হাজার টাকা ব্যয়ে মোজাহার এন্টারপ্রাইজ নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করে। ২০২৩ সালের ৭ মার্চ নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়া এবং সেতুর উচ্চতা সমস্যা নিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেন যশোরের বাসিন্দা ইকবাল কবীর জাহিদ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, টেকারঘাট সেতুর নির্মাণকাজ প্রায় ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডসহ কোনো মালামাল সেখানে নেই। অসমাপ্ত সেতুর পাশে একটি কাঠের তৈরি বিকল্প সেতু দিয়ে ছোট যানবাহন ও মানুষ চলাচল করছে। এসময় সেতু সংলগ্ন বাসিন্দা অভয়নগরের পায়রা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ফিরোজ আলম বলেন, 'আইনি জটিলতায় সেতুর কাজ বন্ধ রয়েছে। ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েছে দুই উপজেলার মানুষ। কাঠের তৈরি বিকল্প সেতু দিয়ে চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ। যে কারণে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। দ্রম্নত সময়ের মধ্যে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ না হলে দুই উপজেলার মানুষ রাস্তায় নামতে বাধ্য হবে।'
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের এক প্রতিনিধি বলেন, 'আদালতের নির্দেশ মেনে কাজ চলছিল। ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু গত ৫ আগস্টের পর নির্মাণ সামগ্রীসহ অন্যান্য মালামাল লুট হয়ে যায়। আমাদের লোকজনকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। কথাগুলো বলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান তিনি।'
রিটকারি ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক ইকবাল কবীর জাহিদ বলেন, 'ছয় মাসের মধ্যে নিয়ম অনুযায়ী কাজ শেষ করে রিপোর্ট করার নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। আদালতের দেওয়া সময় শেষ হয়ে গেছে। অথচ এলজিইডি কিছুই করেনি। যে কারণে দায় এড়াতে পারে না তারা। এখন এলজিইডি হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।'
এ ব্যাপারে যশোর জেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আহমেদ মাহবুবুর রহমান বলেন, 'উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞায় টেকারঘাট সেতুর নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলে পুনরায় কাজ শুরু করা হবে।'
তিতাস (কুমিলস্না) প্রতিনিধি জানান, কুমিলস্নার তিতাসে প্রথম ও দ্বিতীয় স্বরসতির চর গ্রাম গড়ে ওঠার প্রায় ২শ' বছর অতিবাহিত হলেও দুইগ্রামের মধ্যে বিরাজমান খালের ওপর কোন সেতু নির্মাণ হয়নি। ফলে কাঠের সাঁকোর মাধ্যমে উভয়প্রান্তের দুই উপজেলার ৯ গ্রামের প্রায় ২০ হাজার মানুষকে যাতায়াতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। পারাপারের সময় প্রায়ই এলাকাবাসী দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে।
সরেজমিনে জানা যায়, উপজেলার সাতানী ইউনিয়নের প্রথম ও দ্বিতীয় স্বরসতির চরের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ কিলোমিটার। খালের উপর প্রায় ২০ বছর আগে নির্মিত একটি কাঠের সাঁকো দিয়ে তিতাসের প্রথম স্বরসতিরচরসহ কাঠালিয়া নদীর অপরপ্রান্তে থাকা মেঘনা উপজেলার কাশিপুর, কাঠালিয়া, চর কাঠালিয়া, লক্ষণখোলা, সেনের চর, রাধানগর, পায়রাবন্ধ, ব্রাহ্মণচরের লোকজন নদী পার হয়ে সাঁকো ব্যবহার করে জেলা শহর কুমিলস্না ও উপজেলা সদরসহ বৃহত্তর বাজার বাতাকান্দিতে যাতায়াত করে। প্রায় ২০ বছর আগে তৎকালিন সাতানী ইউপি চেয়ারম্যান এইচএম সালাহউদ্দিনের উদ্যোগে খালটিতে কাঠের সাঁকো নির্মাণ করা হয়। এর আগে বাঁশের সাঁকো দিয়ে লোকজন পারাপার হতো। বর্তমানে কাঠের সাঁকোটি নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে। ঝুঁকি নিয়েই এপথের লোকজন সাঁকোটি পারাপার হচ্ছে। দীর্ঘ ২০ বছরে ৪জন ইউপি চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করলেও আঞ্চলিকতার তকমা দিয়ে কেউ এখানে সেতু নির্মাণে এগিয়ে আসেনি।
প্রথম স্বরসতীর চর গ্রামের ইউনিয়ন কারিগরি উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র মো. ইয়ামিন বলে, সাঁকো দিয়ে যাওয়ার সময় সাঁকো নড়ে। গ্রামের অনেকে সাঁকো পার হওয়ার ভয়ে স্কুলে যেতে চায় না।
প্রথম স্বরসতীর চরের প্রায় ৭০ বছর বয়সী মজিবুর রহমান বলেন, এই গ্রামের প্রতিষ্ঠা হয়েছে প্রায় ২০০ বছরেও বেশি সময় আগে। কিন্তু উন্নয়নের কোন ছোঁয়া লাগেনি। সরকার বদল হয়েছে অনেকবার, কিন্তু আমাদের ভাগ্য বদল হয়নি।'
দ্বিতীয় স্বরসতীর চরের কৃষক মোবারক হোসেন বলেন, প্রথম স্বরসতির চরের ২০ বিঘা জমিতে এ বছর আমি ভুট্টা ও আলু চাষ করেছি। জমিতে সার নিতে অনেক কষ্ট হয়। লেবার দিয়ে নিতে খরচ অনেক বেশি। অনেক সময় লেবারও পাওয়া যায় না। তখন কষ্ট আরও বেড়ে যায়।
দ্বিতীয় স্বরসতীর চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, প্রতিবছর গ্রামবাসীর উদ্যোগে এটা সংস্কার করা হয়। অনেক সময় এই সাঁকোটি পার হতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা আহত হচ্ছে।
মেঘনা উপজেলার ব্রাহ্মনচরের আবু হানিফ মিয়া জানান, 'সময় ও খরচ বাঁচাতে আমরা প্রায় ঝুঁকিপূর্ণ কাঠের সাঁকো পার হয়ে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে আসছি। তবে সাঁকো দিয়ে মালামাল আনা যায় না।'
সাতানী ইউপি চেয়ারম্যান সামছুল হক সরকার জানান, 'আমি প্রথম নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৮ সালে সেতু নির্মাণের জন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম। হচ্ছে-হবে বলে বারবার আশ্বস্ত করলেও শেষ পর্যন্ত আর অনুমোদন হয়নি। শুনেছিলাম বিগত সরকারের আমলে স্থানীয় সংসদ সদস্য নাকি এটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্মাণ করবে। তাই আমি আর প্রস্তাব দেয়নি।'
উপজেলা প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম জানান, ৩০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি পাকা সেতু নির্মাণের প্রস্তাব পাঠিয়েছি। আশা করি শিগগিরই অনুমোদন পাব।