চলতি রবি মৌসুমের শুরুতে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে বেশি দামে সার বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। এতে বিপাকে পড়েছেন কৃষক। সরবরাহ ঘাটতির দোহাই দিয়ে ডিলাররা বলছে সার নেই, পাওয়া গেলেও দাম বেশি। এ কারণে কৃষকদের চলতি মৌসুমে আলু, পেঁয়াজ, রসুন ও সবজি চাষে ব্যাহত হচ্ছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত-
বালিয়াডাঙ্গী (ঠাকুরগাঁও) প্রতিনিধি জানান, ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বিএডিসি ডিলার, সাব-ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রি করছেন। বিশেষ করে ইউরিয়া, ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি) ও মিউরেট অব পটাশ (এমওপি) সার বেশি দামে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। বড়বাড়ী ইউনিয়ন বিএডিসি ডিলার মেসার্স ভাই ভাই ট্রেডার্স প্রোপাইটার রমজান আলী ও মাহবুবুর রহমানের দোকানে তিন দিন ঘুরেও পাননি এক বস্তা সার। এমন অভিযোগ বড়বাড়ী গ্রামের কৃষক ফারাজুল ইসলামের।
কৃষকদের অভিযোগ, ডিলাররা কৃষকদের কাছে সার বিক্রি না করে অতিরিক্ত দামে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছেন। পরে সেই সার খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে কৃষকদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এরপরও চাহিদামতো সার পাচ্ছেন না তারা। যদিও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সারের কোনো সংকট নেই বলে দাবি করছে।
সোমবার সরেজমিন কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডিলার ও খুচরা সার ব্যবসায়ীরা টিএসপি প্রতি কেজি ২৭ টাকা, প্রতি বস্তা- ১৩৫০ টাকা, এমও.পি প্রতি কেজি ২০ টাকা, প্রতি বস্তা- ১ হাজার টাকা, ডি. এ. পি প্রতি কেজি ২১ টাকা, প্রতি বস্তা এক হাজার ৫০ টাকা। বিক্রেতারা দোকানে মূল্য তালিকা টানিয়ে রাখলেও সে অনুযায়ী বিক্রি করছেন না তারা। প্রতি বস্তা সার সরকারি মূল্যের চেয়ে প্রকারান্তরে ২০০-৩০০ টাকা বেশি দরে বিক্রি করছেন। কৃষক সার কিনতে গেলে ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা সংকটের কথা বলেন।
তবে দাম বেশি দিলেই সার পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া বিক্রেতারা কৃষকদের কোনো সঠিক বিক্রয় রসিদ দেন না। আর যেটা কৃষকদের দেন, এর চেয়ে বেশি দাম দিয়ে সার কিনতে হয়। ডিলার-খুচরা বিক্রেতাদের কাছে তারা এভাবে জিম্মি হয়ে পড়েছে। সরকার অনুমোদিত এসব ডিলার-সাব-ডিলাররা সরকারি নির্দেশনা না মানায় দেখা দিয়েছে সারের কৃত্রিম সংকট। আর এতে বাড়বে কৃষি উৎপাদন খরচ।
উপজেলার বড়বাড়ী ইউনিয়নের রুপগঞ্জ কাশিডাঙ্গা গ্রামের প্রান্তিক কৃষক ফারাজুল ইসলাম বলেন, 'বড়বাড়ী ইউনিয়ন বিএডিসি ডিলার মেসার্স ভাই ভাই ট্রেডার্স প্রোপাইটার রমজান আলী ও মাহবুবুর রহমানের দোকান ও বিতরণ পয়েন্টে তিন দিন ঘুরেও পাইনি এক বস্তা টিএসপি সার। এমন অভিযোগ বড়বাড়ীর আরও অনেক কৃষকের।'
বড়বাড়ী ডিমাবাড়ী গ্রামের কৃষক আব্দুল লতিফ জানান, বর্তমানে আলু, গম ও ভুট্টার চাষাবাদ শুরু হয়েছে। এ সময় টিএসপি, বিওপি ও এমওপি সার সংকট দেখা দিয়েছে। দামের চেয়ে অতিরিক্ত টাকা দিলেই সার মিলছে। বিএডিসি ডিলার ভাই ভাই ট্রেডার্সের মালিক রমজান আলীর কাছে গেলে তিনি বলেন, 'সার নেই। চলতি মাসের বরাদ্দকৃত যে সার তুলেছিলাম, তা এলাকার প্রান্তিক চাষিদের স্স্নীপের মাধ্যমে দিয়ে শেষ হয়ে গেছে।' এই একই অভিযোগ ফারাজুল ইসলামেরও।
দুওসুও ইউনিয়নের দুওসুও বানিয়া পাড়া গ্রামের কৃষক ইউসুফ আলী বলেন, 'ডিলাররা রাতারাতি সার নিয়ে খুচরা বিক্রেতাদের দিয়ে দিচ্ছেন। এ জন্য আমরা সার পাচ্ছি না। উপজেলা প্রশাসন যদি অভিযান চালায়, তাহলে আর সারের কৃত্রিম সংকট থাকবে না।'
ডিলার রমজান আলী জানান, 'চলতি মাসে বরাদ্দ পেয়েছি টিএসপি ৮ মেট্রিক টন, ডিএপি ৩২.২৫ ও এমওপি পেয়েছি ১২.২৫ মেট্রিক টন। চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম পাওয়ার কারণে বাজারে সারের কিছুটা সংকট তৈরি হয়েছে।'
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন বলেন, 'এখন সারের কোনো ঘাটতি নেই। স্যারের বাজার ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং সঠিক চাষিদের মধ্যে বিতরণ বিষয়ে মিটিং হয়েছে। এরপরও সংকটের অজুহাতে বেশি দামে সার বিক্রি করার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছি।'
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পলাশ কুমার দেব নাথ বলেন, বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য অভিযান চলছে। কৃত্রিম সার সংকটের কোনো সুযোগ নেই।
আটঘরিয়া (পাবনা) প্রতিনিধি জানান, সারের কৃত্রিম সংকটে আটঘরিয়া উপজেলার চাষিরা বিপাকে পড়েছেন। সরবরাহ ঘাটতির দোহাই দিয়ে ডিলাররা বলছে সার নাই, পাওয়া গেলেও দাম বেশি। এ কারণে কৃষকদের চলতি মৌসুমে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে।
কৃষকদের অভিযোগ, প্রতি বস্তা সার ৭০০-৮০০ টাকার বেশি দামে বিক্রি করছে কোনো কোনো ডিলার। সার বিক্রেতাদের দাবি, এমপিও ও ইউরিয়া সার অনেকটা স্বাভাবিক থাকলেও অন্য সার অস্বাভাবিক দামে বিক্রি হচ্ছে। বাংলাড্যাপ সার প্রতি বস্তা ১৪০০ টাকার পরিবর্তে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ২২০০ থেকে ২৪০০ টাকা, বিএডিসির ড্যাপ সার ১৩০০ টাকা, টিএসপি (মরোক্ক) সার ১৬০০ থেকে ১৭০০ টাকা এবং বাংলা পতেঙ্গা ২৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত অক্টোবর থেকে আটঘরিয়ার বিভিন্ন এলাকায় আলু, পেঁয়াজ ও সবজি আবাদ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে আলুর চাষ, মুড়ি কাটা পেঁয়াজ রোপণের পরপর চারা পেঁয়াজ রোপণ চলছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন জাতের সবজি চাষও শুরু হয়েছে। এ সময় সারের চাহিদা বেশি হলে সরবরাহ কম বলে জানা গেছে। একদিকে সারের সংকট অন্য দিকে আলু, পেঁয়াজ, রসুন ও সবজি বীজের দাম বৃদ্ধিতে দুশ্চিন্তায় কৃষক।
অভয়নগর (যশোর) প্রতিনিধি জানান, যশোরের অভয়নগরে দুই হাজার ৪২০ বস্তা ডায়ামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) সারসহ ৪টি ট্রাক জব্দ করা হয়েছে। গত রোববার রাতে উপজেলার রাজঘাট এলাকায় নাহার ঘাটে অভিযান চালিয়ে সার ও ট্রাক জব্দ করা হয়।
প্রতারণামূলক সরকারি বরাদ্দকৃত ডিএপি সার আত্মসাৎ করার অপরাধে উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা প্রসেন মন্ডল বাদী হয়ে বিসিআইসির ৩ সার ডিলারের বিরুদ্ধে অভয়নগর থানায় মামলা করেছেন। মঙ্গলবার বিয়য়টি নিশ্চিত করেন অভয়নগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লাভলী খাতুন।
অভিযুক্ত ৩ বিসিআইসি সার ডিলার হলেন- রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার বালিয়াকান্দি বাজারের মেসার্স সোহাগ এন্টারপ্রাইজ, একই জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার গোয়ালন্দ বাজারের সপ্তবর্ণা ট্রেডার্স ও কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার হাকিমপুর বাজারের ইউনিভার্সেল ট্রেড।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লাভলী খাতুন বলেন, প্রতারণামূলক সরকারি বরাদ্দকৃত ডিএপি সার ট্রাকে লোড করা হচ্ছে- এমন সংবাদের ভিত্তিতে রোববার রাতে উপজেলার রাজঘাট এলাকায় নাহার ঘাটে অভিযান চালানো হয়। এ সময় ৫০ কেজি ওজনের দুই হাজার ৪২০ বস্তা ডিএপি সারসহ ৪টি ট্রাক জব্দ করেন। যার মধ্যে সরকারি বরাদ্দকৃত ডিএপি সার এক হাজার ৬২০ বস্তা ও বহির্ভূত একই সার ৮০০ বস্তা ছিল। অভিযান চলাকালে সহকারী কমিশনার (ভূমি) আব্দুলস্নাহ আল ফারুক উপস্থিত ছিলেন। অভয়নগর থানার ওসি এমাদুল করিম বলেন, সার আত্মসাতের ঘটনায় মামলা হয়েছে। জব্দ দুই হাজার ৪২০ বস্তা ডিএপি সারসহ ৪টি ট্রাক আদালতে পাঠানো হচ্ছে।