ঠাকুরগাঁওয়ে হানাদারমুক্ত দিবস উদযাপন

ফুলবাড়ী ও ধানুয়া কামালপুর শত্রম্নমুক্ত দিবস আজ

প্রকাশ | ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০

স্বদেশ ডেস্ক
দিনাজপুরের ফুলবাড়ী ও জামালপুরের বকশীগঞ্জের ঐতিহাসিক ধানুয়া কামালপুর হানাদারমুক্ত দিবস আজ ৪ ডিসেম্বর। এদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে ধানুয়া কামালপুর মুক্ত হয়। এ ছাড়াও গত ৩ ডিসেম্বর ছিল ঠাকুরগাঁওয়ে হানাদারমুক্ত দিবস। সেখানে এ উপলক্ষে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি উদযাপন করা হয়। প্রতিনিধিদেও পাঠানো খবরে বিস্তারিত- ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) প্রতিনিধি জানান, আজ ৪ ডিসেম্বর বুধবার দিনাজপুরের ফুলবাড়ী হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী যৌথভাবে চতুর্মুখী আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানি খানসেনাদের হাতে অবরুদ্ধ ফুলবাড়ীকে মুক্ত করেন। পরে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর উপস্থিতিতে বীর মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় সড়ক ও জনপথ বিভাগের ডাকবাংলো চত্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার নিরীহ বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি খানসেনাদের বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের সংবাদে ২৬ মার্চ ক্ষোভে-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ফুলবাড়ী। স্বাধীনতাকামী হাজারো মানুষ বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রেলস্টেশন ঘুরে পৌর শহরের কাঁটাবাড়ী বিহারিপট্টি হয়ে বাজার এলাকায় আসার পথে মিছিলকে লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করা হলে কয়েকজন মিছিলকারী গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওইদিন বাঙালি ও অবাঙালির (বিহারি) মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে। এ সময় বিক্ষুব্ধ মুক্তিকামী মানুষ ওই এলাকার অবাঙালি চিকিৎসক শওকত আলীর বাড়িতে আগুন দেয়। এতে ডা. শওকত আলীসহ সপরিবারের অন্য সদস্যরা অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। ২ এপ্রিল পাকিস্তানি খানসেনারা ফুলবাড়ী দখলে নিয়ে বিরামপুর, হাকিমপুর, ঘোড়াঘাট ও নবাবগঞ্জ থানার সমন্বয়ে ফুলবাড়ীতে তাদের হেড কোয়ার্টার গড়ে তোলে। একই সঙ্গে স্থানীয় পাকিস্তানপন্থী ব্যক্তিদের নিয়ে রাজাকার, আল-বদর ও আল-সামস বাহিনী গঠন করে। এসব বাহিনীর সহযোগিতায় শুরু হয় বাঙালিদের ওপর বর্বরোচিত নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ হত্যাযজ্ঞ। দীর্ঘ সময় ধরে ফুলবাড়ীর বিভিন্ন এলাকায় খন্ড খন্ড যুদ্ধের একপর্যায়ে ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর আজকের এইদিনে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী ফুলবাড়ীর রাণীনগর, রুদ্রানী, আমড়া, জলপাইতলী, পানিকাটা, বানাহার ও জগন্নাথপুর সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে চতুর্মুখী সাঁড়াশি আক্রমণ চালায় খানসেনাদের ওপর। আক্রমণে টিকতে না পেরে নিজেদের জীবন বাঁচাতে খানসেনারা ফুলবাড়ী ছোট যমুনা নদীর লোহার ব্রিজটি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে ট্রেন ও মেঠোপথে সৈয়দপুরে পালিয়ে যায়। পরে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীরা অবরুদ্ধ ফুলবাড়ীকে মুক্ত করেন। সেই থেকে প্রতিবছর এই দিনে স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা দিবসটি পালন করে আসছেন। বকশীগঞ্জ (জামালপুর) প্রতিনিধি জানান, আজ ৪ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক ধানুয়া কামালপুর হানাদারমুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের আজকের দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে হানাদার বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি কামালপুর দুর্গের পতন হয়। তাই দিনটিকে স্মরণ করে প্রতিবছরই স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারমুক্ত দিবস পালন করে আসছেন। স্থানীয় সূত্র ও ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরা জেলার মহেন্দ্রগঞ্জ ও জামালপুর জেলার পাহাড় ঘেঁষা বকশীগঞ্জ উপজেলার ধানুয়া কামালপুরে হানাদার বাহিনী যুদ্ধের শুরু থেকেই শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। এখান থেকেই হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা চালায়। উত্তর রণাঙ্গনের ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল যে কোন মূল্যে এই ঘাঁটি দখল করা। যুদ্ধে কামালপুর রণাঙ্গনে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ৮ দফা সম্মুখ যুদ্ধ হয়। ১০ দিন প্রচন্ড যুদ্ধের পর ৪ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় সেক্টর কমান্ডারের নিদের্শক্রমে সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা বশির আহমেদ (বীরপ্রতীক) নিজের জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে সারেন্ডার পত্র নিয়ে যাওয়ার পর সন্ধ্যা ৭টায় ৩১ ব্যালুচ রেজিমেন্টের গ্যারিসন কমান্ডার আহসান মালিকসহ ১৬২ জন হানাদার সদস্য মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এর মাধ্যমে শত্রম্নমুক্ত হয় ধানুয়া কামালপুর। মহান মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ সংগঠিত হয় এই ধানুয়া কামালপুরে। ধানুয়া কামালপুর যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ (বীরউত্তম), মুক্তিযোদ্ধা গাজী আহাদুজ্জামান, তসলিম উদ্দিনসহ শহীদ হন ১৯৭ জন মুক্তিযোদ্ধা। গুলিবিদ্ধ হয়ে ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বীরবিক্রম (সাবেকমন্ত্রী মেজর হাফিজ)সহ অনেকেই পঙ্গুত্ববরণ করেন। অন্যদিকে একজন ক্যাপ্টেনসহ হানাদার বাহিনীর ২২০ জন সৈন্য মারা যায় এ যুদ্ধে। ধানুয়া কামালপুর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ২৯ জনকে তাদের বীরত্বের জন্য বীরবিক্রম, বীরউত্তম ও বীরপ্রতীক খেতাব দেওয়া হয়। শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে তৎকালীন বিডিআরের (বর্তমানে বিজিবি) নিজস্ব অর্থায়নে ধানুয়া কামালপুর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মাণ করা হয়েছে ধানুয়া কামালপুর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি জানান, ৩ ডিসেম্বর, ঠাকুরগাঁও হানাদারমুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঠাকুরগাঁও মুক্ত হয় পাকিস্তানি হানাদারদের কবল থেকে। দিনটি উপলক্ষে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে। সকালে ঠাকুরগাঁও প্রেস ক্লাবের সামনে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সংবলিত স্মৃতিফলকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা, বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, জেলা বিএনপি এবং স্থানীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন। পরে মির্জা রুহুল আমিন মিলনায়তনে বিশেষ আলোচনা সভা হয়। সেখানে দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরা হয় এবং পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হওয়ার ঘটনাগুলো স্মরণ করা হয়। সভায় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন, যা তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পৌঁছে দেওয়ার আহ্বান জানান। হরিপুর (ঠাকুরগাঁও) প্রতিনিধি জানান, ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরে হানাদারমুক্ত দিবস পালিত হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ১০টায় দিবস উদযাপন উপলক্ষে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। এরপর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুজ্জামানের সভাপতিত্বে উপজেলা পরিষদ সভাকক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় বক্তব্য রাখেন- উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নগেন কুমার পাল, উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক উপাধ্যক্ষ জামাল উদ্দিন, কৃষি কর্মকর্তা রুবেল হোসেন, হরিপুর থানার তদন্ত ওসি শরিফুল হক, উপজেলা প্রাথমিক সহকারী কর্মকর্তা ইবনে সুলতান জাহিদ, খাদ্য কর্মকর্তা আবুল কালামসহ মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক ও সুশীল সমাজের লোকজন। পীরগঞ্জ (ঠাকুরগাঁও) প্রতিনিধি জানান, ৩ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে হানাদারমুক্ত দিবস পালন করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণপণ লড়াইয়ের মুখে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। অবশেষে ৩ ডিসেম্বর ভোররাতে শত্রম্নমুক্ত হয় পীরগঞ্জ। চৌরাস্তায় উড়ানো হয় বিজয় পতাকা। দিবসটি পালনে মঙ্গলবার সকালে পীরগঞ্জ প্রেস ক্লাবের আয়োজনে প্রেস ক্লাব চত্বর থেকে শোভাযাত্রা বের হয়। পরে কেন্দ্রীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে আলোচনা সভা হয়। উপজেলা প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতায় এতে বক্তব্য রাখেন- সাবেক এমপি জাহিদুর রহমান, পীরগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর বদরুল হুদা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রমিজ আলম, বীর মুক্তিযোদ্ধা হাফিজুর রহমান, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জিয়াউল ইসলাম জিয়া, ঠাকুরগাঁও আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নাল আবেদিন, থানার ওসি তাজুল ইসলাম, উপজেলা জামায়াতের আমির বাবলুর রশিদ, সিপিবির সভাপতি প্রভাত সমীর শাহজাহান আলম, পীরগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি জয়নাল আবেদিন বাবুল, সাধারণ সম্পাদক নসরতে খোদা রানা প্রমুখ।