দেশে দিন দিন বেড়েই চলেছে মাল্টার চাষ বাগান দেখতে আসছেন ভ্রমণ পিপাসুরা

কমলা-মাল্টা গাছে ঝুলছে স্বপ্ন, লাখ লাখ টাকা আয়

প্রকাশ | ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

স্বদেশ ডেস্ক
গাছে ঝুলছে কাঁচা-পাকা মাল্টা ও কমলা। এ যেন গাছে স্বপ্ন ঝুলছে। দেশে দিন দিন বেড়েই চলেছে মাল্টা ও কমলার চাষ। এসব ফলের চাষ করে অনেকে হচ্ছেন স্বাবলম্বী। আয় করছেন বছরে লাখ লাখ টাকা। শিক্ষার্থী, বেকার ও প্রবাসীরাও ঝুঁকছেন কমলা ও মাল্টা চাষে। এ প্রতিবেদনে জানাবো বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী, বিদেশ ফেরত প্রবাসী এবং কৃষকের কমলা ও মাল্টা চাষে সাফল্যের গল্প। স্টাফ রিপোর্টার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে চায়না থ্রি জাতের কমলার চাষ করে কৃষিতে নতুন চমক সৃষ্টি করেছেন প্রবাস ফেরত দুই যুবক আলমগীর ভূইয়া ও খোকন মিয়া। বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের দুলালপুর গ্রামের বাসিন্দা আলমগীর ভূইয়া ও একই ইউনিয়নের ছতুরপুর গ্রামের খোকন মিয়া দুইজনই প্রবাসে ছিলেন। জীবন-জীবিকার তাগিদে কয়েক বছর আগে বিদেশ চলে যান তারা। সেখানে তেমন সুবিধা না করতে পেরে পরে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে ইউটিউবের ভিডিও দেখে কমলা চাষের প্রতি আগ্রহী হন তারা। প্রথমবার উপজেলায় চায়না থ্রি জাতের কমলা চাষের উদ্যোগী হন আলমগীর ভূইয়া। তিনি চুয়াডাঙ্গা থেকে কমলার চারা এনে প্রথমে ২ বিঘা জমিতে রোপণ করেন। তখন অনেকেই তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। এক বছর পর তার রোপণ করা চারা গাছে কমলা আসতে শুরু করে। পরে তার করা বাগান দেখে ছতুরপুর গ্রামের প্রবাস ফেরত খোকন মিয়াও চায়না ও দার্জিলিং জাতের কমলা চাষে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাগান করেন। বর্তমানে তারা দু'জনই চায়না ও দার্জিলিং জাতের কমলা চাষে সফল হয়েছেন। কমলা চাষে তাদের আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে। বিগত বছরগুলোর তুলনায় এ বছর কমলার ফলন ভালো হয়েছে। পুরো বাগানে সবুজ পাতার আড়ালে ঝুলছে হলুদ রঙের কমলা। ছতুরপুর গ্রামের কমলা চাষি খোকন মিয়া জানান, দুই বিঘা জমিতে ৬০টি দার্জিলিং এবং ১০০টি চাইনা থ্রি জাতের কমলার চারা রোপণ করে বাগান গড়ে তুলি। ইউটিউব দেখে বাগানের পরিচর্যা করে ভালো ফলন পেয়েছি। বাগানের গাছে-গাছে সবুজ পাতার আড়ালে ঝুলছে পাকা রসালো কমলা। আমার বাগান থেকে এ বছর অন্তত ৫ লাখেরও অধিক টাকার কমলা বিক্রির আশা করছি। বিজয়নগরে প্রথম কমলা চাষি আলমগীর ভূইয়া জানান, দীর্ঘদিন প্রবাস জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে মাত্র দুই বিঘা জমি ১৬ বছরের জন্য বর্গা নিয়ে ইউটিউব দেখে চায়না কমলা-থ্রি জাতের কমলার চাষ শুরু করেন। মাত্র ৪ লাখ টাকা নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে শুরু করেন চাষাবাদ। গত বছর তার বাগান থেকে ১৩ লাখ ৬৬ হাজার টাকার কমলা বিক্রি করেছিলেন। এ বছর আরও বেশি বিক্রি করতে পারবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি। এদিকে বিজয়নগরে কমলা চাষের খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার হলে বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শনার্থীরা বাগান দেখতে প্রতিদিনই ভিড় করছেন। বাগানে এসে ফটোসেশন, সেলফি তুলতে দেখা গেছে অনেককেই। উপজেলা কৃষি অফিসের দেওয়া তথ্যমতে, ইতোমধ্যে এ অঞ্চলের লিচুর খ্যাতি পুরোদেশ জুড়ে। কাঁঠাল, পেয়ারা, ড্রাগন, আম, আনারস, বড়ই, গ্রীন মাল্টা চাষ হচ্ছে। আখাউড়া থেকে কমলা বাগান দেখতে আসা খাজিদা আক্তার বলেন, 'কমলা বাগানে এত সুন্দরভাবে কমলা ঝুলে আছে যা দেখে মন জুড়িয়ে গেল।' বাগানে পরিচর্যা ও প্রতিনিয়ত কাজ করেন ছাত্তার মিয়া। তিনি বলেন, 'বাগান দেখাশুনাসহ কমবেশি সব কাজ করি। এই বাগানে আমরা ৩/৪ জন কাজ করি। এখানে কাজ করে আমাদের পরিবারের অর্থের যোগান দিচ্ছি।' বিজয়নগর উপজেলা কৃষি অফিসার সাব্বির আহমেদ বলেন, 'জমি উপযোগী হওয়ায় উপজেলায় কমলা ও মাল্টা বাগানের আবাদ ক্রমশ বেড়েই চলছে। বাগান করে সফল হচ্ছেন কৃষকরা। কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে তাদের সার্বিক তত্ত্বাবধান ও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।' রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, স্বপ্ন দেখতাম পড়াশোনার পাশাপাশি ছাত্র জীবনেই একজন সফল উদ্যোক্তা হবো। উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছায় দিনরাত নানাভাবে ভাবতাম। একজন শিক্ষকের বাসার ছাদে মাল্টা চাষ দেখে আমি অনুপ্রাণিত হই। করোনার মধ্যে ৯৬০টি মাল্টা গাছ রোপণের মাধ্যমে শুরু করি মাল্টা চাষ। ফলনের প্রথম বছরে সফলতা ধরা না দিলেও চলতি মৌসুমে দশ লাখ টাকা মাল্টা বিক্রি হবে বলে আশা করছি। এ প্রজেক্টে সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনা এবং সুযোগ-সুবিধা পেলে মাইলফলক সৃষ্টি করতে পারবো। এভাবেই নিজের উদ্যোক্তা হয়ে উঠার পেছনের গল্পগুলো বলছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) লোকপ্রশাসন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তরুণ উদ্যোক্তা মো. ফারাদুজ্জামান ফাহিম। ফাহিম নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার মির্জাগঞ্জ গ্রামের মোজাম্মেল হক ও ফরিদা বেগম দম্পতি পাঁচ সন্তানের মধ্যে তৃতীয়। ফাহিম জানায়, ২০২১ সালের জুলাই মাসে ৩.১৫ একর জমিতে ৯২০টি মাল্টা ও ৪০টি কমলার চারা রোপণ করেন ফাহিম। রোপণের দ্বিতীয় বছর আশানুরূপ ফলন না পেলেও হতাশ হননি তিনি। ২ লক্ষ ২০ হাজার টাকার মাল্টা বিক্রি করেন ফলনের প্রথম বছরে। চলতি বছরে ইতোমধ্যে ৩ লাখ টাকার মাল্টা বিক্রি করেন ফাহিম। তিনি আরও জানায়, ২০২১ সালে ক্যান্টনমেন্ট স্কুল এন্ড পাবলিক কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় এক শিক্ষকের ছাদ বাগানে মাল্টা চাষ দেখে আমি অনুপ্রাণিত হই, পরে সশরীরে বিভিন্ন বাগান পরিদর্শন করি এবং স্থানীয় ডোমার উপজেলা কৃষি বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তৎকালীন উপজেলা কৃষি অফিসার আনিসুজ্জামান স্যারের পরামর্শক্রমে বাগান স্থাপন করি। ফাহিমের বাগান ঘুরতে এসে অভিভূত হোন তার স্কুল শিক্ষক মো. দুলাল উদ্দিন। এমন উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি বলেন, ফাহিমের মাল্টা বাগানে গিয়ে আমি সত্যি অভিভূত হয়েছি। ডোমার উপজেলার কৃষি অফিসার রফিকুল ইসলাম বলেন, 'ফাহিম ডোমার উপজেলার একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তা। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারাও তাকে নিয়মিত পরামর্শ দেন। ফাহিমের মতো তরুণ উদ্যোক্তাদের হাত ধরে বদলে যাবে বাংলাদেশের কৃষি কার্যক্রম।' রূপসা (খুলনা) প্রতিনিধি জানান, খুলনার রূপসায় পাঁচ বিঘা জমিতে জৈব প্রক্রিয়ায় রাসায়নিক মুক্ত মাল্টা বাগান গড়ে তুলে এলাকাবাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন কৃষক জাহাঙ্গীর ফকির (৪৮)। তিনি ২০২১ সালে গড়ে তোলেন এ বাগান। চলতি মৌসুমে প্রায় লাখ টাকার ফল বিক্রি করেছেন তিনি। তিন বছর আগে প্রায় পাঁচ বিঘা জমিতে বাণিজ্যিকভাবে তিনি মাল্টা চাষ শুরু করেন। বর্তমানে প্রতিটি গাছে অসংখ্য মাল্টায় তার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করেছে। তার বাগানে ভালো ফলন হওয়ায় বাগান দেখতে আগ্রহী চাষিরা দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই ছুটে আসছেন। মাল্টা চাষি জাহাঙ্গীর ফকির বলেন, 'একসময় বেকার জীবন কাটানোর পর কৃষিতে যুক্ত হলেও সফলতা পাইনি। একপর্যায়ে চুয়াডাঙ্গা বেড়াতে গিয়ে প্রচুর দেশি মাল্টার গাছ দেখতে পাই। চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, মাল্টা চাষ করে তারা লাভবান। আমিও ফল বাগান করতে আগ্রহী হয়ে পড়ি। ওই জেলা থেকে মাল্টার চারা সংগ্রহ করে শুরু করি মাল্টা বাগান। 'এ বছর অর্ধ-লাখ টাকার মাল্টা বিক্রি করতে পারবো বলে আশা করছি।' মাল্টা চাষি বলেন, 'দেশি মাল্টা ও কমলা গাছে পোকার আক্রমণ খুবই কম। এরপরও গাছে পোকা-মাকড় আক্রমণ করলে সিডিউল স্প্রে করতে হয়।' উপজেলার সদর ইউনিয়নের কাজদিয়া বাজারের ফল বিক্রেতা খোকন বলেন, 'ফলটি খুব সুস্বাদু হওয়ায় ক্রেতাদের কাছে দেশি মাল্টার চাহিদা ব্যাপক। আমি প্রতি কেজি মাল্টা ১০০ টাকা করে বিক্রি করছি।' এ চাষির অভিযোগ, প্রায় দুই বছর ধরে রূপসা উপজেলা কৃষি অফিসের কোনো ধরনের সহযোগিতা পাননি। যিনি ওই বস্নকের দায়িত্বে আছেন, তিনি কোনো খোঁজখবর নেন না। খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, 'জেলার রূপসা উপজেলা ছাড়াও ডুমুরিয়া, পাইকগাছা, বটিয়াঘাটা উপজেলায় দেশি মাল্টার চাষ হচ্ছে। এ বছর জেলায় ৭৫ হেক্টর জমিতে দেশি মাল্টা চাষ হচ্ছে। বিশেষ করে বারি মাল্টা-১। মাল্টা চাষ করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। কৃষি অফিস মাল্টা চাষিদের পাশে থেকে সবসময় সেবা দিয়ে যাচ্ছে।'