শুরু হয়েছে সুমিষ্ট খেজুর রস আহরণের মহোৎসব

কালের পরিক্রমায় কমেছে খেজুর গাছ সরকারিভাবে গাছ সংরক্ষণের দাবি

প্রকাশ | ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

স্বদেশ ডেস্ক
'মাটির হাঁড়ি কাঠের গায়, গলা কেটে দুধ দোহায়'- গ্রাম বাংলার জনপ্রিয় এ শ্লোক মনে করিয়ে দেয় খেজুর গাছের গলায় মাটির হাঁড়ি ঝুলিয়ে তা থেকে সংগ্রহ করা সুমিষ্ট রস আহরণের মহা উৎসবের কথা। যে উৎসব শুরু হয় নভেম্বরের প্রথম থেকে। শীতের আগমনী বার্তার সঙ্গে তার পূর্ণতা পায় গ্রাম বাংলার প্রতিটি ঘরে। সকালে খেজুরের গাছ থেকে সংগ্রহ করা সুমিষ্ট রসের তৈরি পিঠা-পায়েশ যেন বাঙালিয়ানাকে পরিপূর্ণতা দান করে প্রাকৃতিকভাবে। খেজুর রসের মিষ্টি গন্ধে মো মো করে গৃহস্থের রান্না ঘর। নতুন ধানের চাল আর শীতের সকালে গরম খেজুর রসে ভেজানো পিঠা সব মিলিয়ে গ্রামগঞ্জে শুরু হয়েছে নবান্ন উৎসব। তাই খেজুরের রস সংগ্রহে গাছিদের মধ্যে শুরু হয়েছে ব্যস্ততা। সালথা (ফরিদপুর) প্রতিনিধি জানান, ফরিদপুরের খেজুরের গুড় ও পাটালির খ্যাতি আছে দেশজুড়ে। এক যুগ আগেও জেলার বিভিন্ন স্থানে শীতের সকালে চোখে পড়তো খেজুর রসের হাঁড়ি ও খেজুর গাছ কাটার সরঞ্জামসহ গাছিদের ব্যস্ততার দৃশ্য। কালের পরিক্রমায় কমে গেছে খেজুর গাছ, সেই সঙ্গে গাছিও কমে গেছে। তবে এ বছর শীত ও কুয়াশা আসার আগেই জেলার সালথা উপজেলায় খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত সময় পার করছেন গাছিরা। প্রায় ৩ হাজার গাছ প্রস্তুত করেছেন তারা। জানা যায়, খেজুরের রস আহরণের মধ্য দিয়েই গ্রামীণ জনপদে শুরু হয় শীতের আমেজ। গাছিরা ভোরবেলা দড়ি-কাছি, ছ্যান ও দাও নিয়ে বেরিয়ে পড়েন রস সংগ্রহের জন্য গাছ প্রস্তুত করার কাজে। প্রথমে ধারালো দা দিয়ে খেজুর গাছের মাথার সোনালি অংশ বের করেন তারা। তারপর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে রাসায়নিক কোনো দ্রব্য ব্যবহার ছাড়াই খাঁটি গুড় তৈরি করেন এখানকার গাছিরা। শীত মৌসুমে রস-গুড় উৎপাদন করে প্রায় ৫ থেকে ৬ মাস স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন এ উপজেলার শতাধিক কৃষক পরিবার। এ থেকে স্থানীয় কৃষক অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হন। সালথা উপজেলার যদুনন্দী ইউনিয়নের গাছি সাহাদৎ ফকির ও আল আমিন জানান, খেজুরের রস সংগ্রহ অনেক কষ্টের কাজ। তাই সহজে কেউ এ কাজ করতে চায় না। যারা বেশি দরিদ্র তারাই খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করেন। বর্তমানে চলছে গাছ ছোলার কাজ। ১০ দিন পর গাছে নল স্থাপনের মাধ্যমে শুরু হবে সুস্বাদু খেজুর রস আহরণের মূল কাজ। তার কয়েকদিন পরই গাছে লাগানো হবে মাটির হাড়ি। সংগ্রহ করা হবে মিষ্টি স্বাদের খেজুরের রস। তা দিয়ে তৈরি হবে লোভনীয় গুড় ও পাটালি। এই গুড় ও পাটালি বাজারে বিক্রি করে চলবে গাছিদের সংসার। উপজেলা নির্বাহী অফিসার আনিছুর রহমান বালী বলেন, সালথায় আনুমানিক তিন হাজার খেজুরের গাছ থেকে রসের জন্য প্রস্তুত করছেন গাছিরা। সামনে গাছিদের একত্রিত করে সতর্ক করবেন, যেন তারা কোনো রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার না করেন। মানসম্মত গুড় তৈরি করে বাজারজাত করেন। শায়েস্তাগঞ্জ (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ ও খেজুরের রস। শীত মৌসুম এলেই এক সময়ে গ্রাম-বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে খেজুরের রস দিয়ে ফিরনি, পায়েস, রসের গুড় দিয়ে ভাপা পিঠা এবং ঘন রস তৈরি করে মুড়ি, চিড়া, খই ও চিতই পিঠাসহ হরেক রকম পিঠাপুলির মহা উৎসব চলত। কিন্তু আগের মতো গ্রামীণ রাস্তার দুইপাশে সারি সারি খেজুর গাছ আর নেই। গ্রামের রাস্তাগুলো সংস্কার ও নতুন করে খেজুর গাছ রোপণে মানুষের আগ্রহের অভাবে বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ ও খেজুরের রস ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। তবে এখনো রাস্তার আশপাশে কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু খেজুর গাছ। আর রস আহরণে এখনো গ্রামীণ রীতিতে ঝুঁকি নিয়েই কোমরে রশি বেঁধে শীতের বিকালে ছোট-বড় মাটির হাঁড়ি গাছে বেঁধে তা থেকে রস সংগ্রহ করছেন গাছিরা। এক সময় এ কাঁচা রস এলাকার বিভিন্ন স্থানে ও হাট-বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন গাছিরা। আবার কেউ সকালে রস উঁনুনে চাপিয়ে গুড়-মিঠাই তৈরি করতেন। প্রতিবছর এ মৌসুমে অযত্নে অবহেলায় পথে প্রান্তরে পড়ে থাকা খেজুর গাছের রস ও গুড় বিক্রি করে এ সময়ে বাড়তি আয় করতেন তারা। গাছি আব্দুল হক মিয়া বলেন, রাস্তাগুলো সংস্কার হওয়ায় খেজুর গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। কিন্তু নতুন করে আর কেউ গাছ লাগাচ্ছে না। বর্তমানে যে হারে খেজুর গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে তাতে এক সময় হয়তো এলাকায় খেজুর গাছ দেখাই যাবে না। নুরপুর ইউনিয়নের আব্দুল হক মিয়া এক সময় শীত এলেই গাছি হিসেবে কাজ করতেন। গ্রামে গ্রামে বিক্রি করতেন খেজুরের রস। কিন্তু এখন খেজুরের গাছ অনেকটা বিলুপ্ত হলেও তিনি ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করে চলেছেন। ব্রিজের কাছের গাছে তিনি কলস লাগিয়েছেন। বিকালের দিকে কলস লাগালে সারা রাতে কলস ভরপুর হয়ে ওঠে রসে। আব্দুল হক মিয়ার কাছ থেকে খেজুরের রস কিনতে এসেছেন মোস্তফা জামান হৃদয় ও ইসমাইল হোসেন এলিন। ইসমাইল হোসেন এলিন জানান, 'অনেকদিন পর খেজুরের রসের সন্ধান পেয়েছি। রস দিয়ে পায়েস আমার খুব পছন্দ। তাই বাসার জন্য এক জগ কিনেছি, প্রায় তিন লিটার হবে। আমি রসওয়ালা দাদুকে খুশি হয়ে ২০০ টাকা দিয়েছি।' মোস্তফা জামান হৃদয় জানান, সচরাচর খেজুরের রস পাওয়া যায় না। সরকারিভাবে এসব গাছ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। হবিগঞ্জ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুকান্ত ধর বলেন, খেজুর গাছ এবং এর রস ঐতিহ্যগতভাবে বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। পুষ্টিগুণ এবং মিষ্টতায় এর জুড়ি মেলা ভার। খেজুরের রস এবং এর রস থেকে তৈরি গুড় বাংলার পিঠা উৎসবের মূল অনুষঙ্গ। বর্তমানে খেজুর গাছের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। পতিত জমিতে এবং রাস্তার দুইপাশে খেজুর গাছ লাগানো যেতে পারে। বর্তমানে অনেকে বাণিজ্যিকভাবে সৌদি খেজুরের বাগান করছেন। কিন্তু তার পরিমাণ অনেক কম। সরকারি উদ্যোগে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় দেশি খেজুরের সম্প্র্রসারণের সম্ভাব্যতা যাচাই করা যেতে পারে। স্থানীয়ভাবে কৃষি বিভাগ এ বিষয়ে প্রচারণা করছে। ঈশ্বরদী (পাবনা) প্রতিনিধি জানান, ঈশ্বরদী উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে খেজুর গাছ থেকে শীতকালীন রস সংগ্রহ করতে ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা গেছে গাছিদের। কিছু কিছু অঞ্চলে গাছিদের গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে সেই রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করতেও দেখা গেছে। উপজেলার মুলাডুলি ইউনিয়নের মালিথা পাড়ার গাছি মো. মামুন বলেন, খেজুর গাছের রস থেকে গুড় তৈরির প্রক্রিয়াটা মূলত শুরু হয় শীতের শুরু থেকেই। প্রথমে খেজুরের প্রতিটি গাছকে তার কান্ডের দিকের শাখাগুলো ছেটে ফেলা হয়। শাখা ছেটে পরিষ্কার করার পর গাছগুলোকে কয়েকদিন ওভাবেই রাখতে হয়। এভাবে রাখার কয়েকদিন পর মূলত গাছগুলো রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত হয়। সেই মোতাবেক গাছগুলোতে ধারালো এক ধরনের হেসে দিয়ে বিশেষ কায়দায় চেঁচে সেগুলো তো একটি করে বাঁশের নল এবং মাটির হাঁড়ি ঝোলানোর জন্য দু'টি করে খুঁটি গাড়া হয়। এরপর হাঁড়িতে চুনকাম করে রোদে শুকানোর পর রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত সেই হাঁড়ি সন্ধ্যা রাতে ঝোলানো হয় প্রতিটি গাছে। তিনি আরও বলেন, সারারাত হাড়িতে জমা রস গাছ থেকে সংগ্রহের কাজ শুরু হয় রাত তিনটা থেকে। সংগৃহীত সেই রস পাতলা কাপড়ে ছেকে গুড়ের জন্য বিশেষভাবে তৈরি বড় কড়াইতে বসিয়ে দেওয়া হয় চুলায় (উনুনে)। এরপর ধীরে ধীরে জ্বাল দিতে থাকলে একটা সময় তরল রসগুলো গারো আঠালোতে পরিণত হয়। এরপর স্বাদ মোতাবেক সেগুলোকে বিভিন্ন আকারের পাত্রে ঢেলে কয়েক ঘণ্টা ঠান্ডা স্থানে রেখে দিলেই জমে পাটালি গুড়ের শক্ত ঢিমিতে পরিণত হয়। সে অবস্থাতেই সেগুলো বাজারজাত করা হয়। সাঁড়া ইউনিয়নের মাঝদিয়ায় কর্মব্যস্ত গাছি মুক্তার আলী বলেন, 'বছরের শীত মৌসুমে আমাদের ব্যস্ততা বেড়ে যায় বহুগুণে। যদিও আমরা এ সময়টাকেই উপার্জনের সেরা সময় হিসেবে বিবেচনায় রাখি। কেননা সারা বছরের ঢিলেঢালা কাজের মধ্যে এ সময় আমাদের সারা বছরের আহার সঞ্চয়ের প্রধান সময়। তবে অন্য বছরের তুলনায় এবার খরচ বেড়েছে প্রায় দেড় গুণ। জ্বালানির দাম, গাছের বর্গা মূল্য সব মিলিয়ে এবার বেশি খরচ হচ্ছে। উপযুক্ত বাজার আর অনুকূল আবহাওয়া না থাকলে এবার বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখিন হতে হবে। কোটচাঁদপুর (ঝিনাইদহ) প্রতিনিধি জানান, শীত আসছে। তাই এ অঞ্চলের গাছিদের মধ্যে পড়ে গেছে খেজুর গাছে রস আহরণের প্রস্তুতির ধুম। গাছিরা পাতলা ধারালো দা নিয়ে কোমরে মোটা দড়ি ও ঠোঙ্গা বেঁধে খেজুর গাছের মাথার একপাশে কেটে দিয়ে রসের প্রস্তুতির জন্য ব্যস্ত সময় পার করছেন। এ প্রস্ততি সম্পন্ন হলেই আর কদিন পর খেজুর গাছে ঝোলাবেন ভাড় বা ছোট মাটির ঠিলা। তখন এলাকার গ্রামাঞ্চলের বাতাস ভরে উঠবে নোলিন গুড় পাটালির সু-ঘ্রাণ। শীতের মৌসুম আসন্ন। তাই ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার গ্রাম অঞ্চলে গাছিদের এমন প্রস্তুতি চোখে পড়ার মতো। স্থানীয় ভাষায় যারা খেজুরের রস সংগ্রহ করেন তাদের গাছি বলা হয়। সকালে রসের জন্য খেজুর গাছ প্রস্তুত করার সময় কথা হয় বলুহর রামচন্দ্রপুর গ্রামের নূর ইসলাম নামের এক গাছির সঙ্গে। তিনি বলেন, কৃষি কাজের পাশাপাশি শীত মৌসুমে গাছ থেকে রস নিয়ে খেজুরের গুড় ও পাটালি তৈরি করেন। এতে বাড়তি কিছু টাকা আসে। শীত যত বেশি পড়বে গাছের রস তত বেশি সুমিষ্টি হবে। আর রস যত মিষ্টি হবে গুড় তত বেশি হবে। এক একটি গাছে এক ভাড় (ঠিলা) পর্যন্ত রস পাওয়া যায়। ভালো-মন্দ মিলে তার খেজুর গাছ আছে ৫০টি। সপ্তাহে পালাক্রমে রস সংগ্রহ করবেন। কোটচাঁদপুর উপজেলা কৃষি অফিসার রাজিবুল হাসান বলেন, মূলত ঝিনাইদহ জেলায় খেজুরের গুড় সব থেকে ভালো হয়। কোটচাঁদপুর উপজেলায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে খেজুর গুড়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৭১ মে. টন। রসের পরিমাণ ২৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৫০ লিটার। আগামীতে রস ও গুড়ের চাহিদার কথা বিবেচনা করে বনবিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে সরকারি রাস্তার ধারে খেজুর গাছ লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে।