কুমিলস্নায় বৈষম্যের শিকার বেসরকারি এতিমখানার ১৫ হাজার দুস্থ শিশু
ডাটা এন্ট্রির নামে নতুন হয়রানি এতিম-দুস্থ শিশুদের শিক্ষা বিমুখের ষড়যন্ত্র
প্রকাশ | ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
মো. আবদুল জলিল ভুঁইয়া, কুমিলস্না
কুমিলস্নায় নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে বেসরকারি এতিমখানার প্রায় ১৫ হাজার দুস্থ এতিম অসহায় শিশু শিক্ষার্থী। জেলার তিন শতাধিক বেসরকারি এতিমখানায় ১৫ হাজার সুবিধাবঞ্চিত শিশু শিক্ষা গ্রহণ করলেও ক্যাপিটেশন পাচ্ছে মাত্র সাত হাজার শিশু। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির হালে এতিমখানার এসব নিবাসীদের নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে পরিচালকরা। নিবাসীদের দাবি, সরকারি শিশু সদনে প্রতি নিবাসীকে মাসে ৪ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও বেসরকারি এতিমখানায় দেওয়া হচ্ছে মাত্র দুই হাজার টাকা। এতে তাদের আমিষ তো দূরের কথা প্রয়োজনীয় খরপোষ জোগাড় করতেই ত্রাহি অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের এমন বৈষম্যমূলক আচরণে সারাদেশের তিন লক্ষাধিক নিবাসী অনেকটাই মানবেতর জীবন যাপন করছে। এদিকে এসব বৈষম্য দূর করতে লিখিত আবেদন করেছে বাংলাদেশ বেসরকারি এতিমখানা কল্যাণ পরিষদ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সারাদেশে চার হাজার ৫৫টি বেসরকারি এতিমখানা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে তিন লক্ষাধিক দুস্থ অসহায় এতিম শিশু শিক্ষা গ্রহণ করছে। এর মধ্যে এক লাখ ১৬ হাজার ৬৬৬ জন নিবাসী ক্যাপিটেশন সুবিধা পাচ্ছে। সরকারি এতিমখানায় প্রতি শিক্ষার্থীকে মাসে চার হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানে যতজন দুস্থ এতিম নিবাসী থাকে সবাই ক্যাপিটেশন পায়। কিন্তু বেসরকারি এতিমখানার নিবাসীরা এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বেসরকারিতে শতকরা ৫০ ভাগ নিবাসীকে ক্যাপিটেশন দেওয়া হয়। প্রতি শিক্ষার্থী মাসে মাত্র দুই হাজার টাকা করে বরাদ্দ পায়। দীর্ঘ বছর ধরে এমন বৈষম্যের মাঝেও সমাজসেবা অধিদপ্তরের নতুন নীতিমালার যাতাকলে পিষ্ট হচ্ছে অসহায় এসব দুস্থরা। সম্প্রতি এতিমখানাগুলোকে ডাটা এন্ট্রির আওতায় আনার একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিপাকে পড়েছে এতিমখানা কর্তৃপক্ষ। এতিমখানাগুলোতে প্রশিক্ষিত কম্পিউটার অপারেটর এবং প্রয়োজনীয় এক্সেসরিজ বরাদ্দ না দিয়েই তাদের ডাটা এন্ট্রির আওতায় আনতে চাপ দিচ্ছে। এতে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। তাছাড়া দুস্থ এবং অসহায় পরিবারের শিশুদের ইউনিয়ন পরিষদ থেকে প্রত্যয়নপত্র দিতে হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেছে। অধিকাংশ অভিভাবক ভাসমান হওয়ায় তারা বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে প্রত্যয়নপত্র পাচ্ছেন না। কোনো কোনো অভিভাবক সন্তানকে দুস্থ হিসেবে প্রত্যয়নপত্র নিতে অনীহা প্রকাশ করছেন। এতে দিন দিন এসব এতিমখানা বিমুখ হচ্ছে দুস্থ শিশুরা। নতুন নতুন নিয়ম-নীতিমালা প্রণয়ন করে দুস্থদের এতিমখানায় লেখাপড়ার পথ বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন অনেকে।
এর আগে এসব বিষয় নিয়ে বেসরকারি এতিমখানা কল্যাণ পরিষদ সমাজ সেবা অধিদপ্তরে লিখিত আবেদন করেছে। এতে বেসরকারি এতিমখানার বরাদ্দ দুই হাজার থেকে চার হাজার টাকায় উন্নীত, ৫০% থেকে ৮০% শিক্ষার্থীর ভাতা বরাদ্দ, ঝাড়ুদার, ক্লিনার, বাবুর্চি, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা চালু ও ডাটা এন্ট্রিসহ নানাভাবে হয়রানি বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে।
সরেজমিন, জেলার মুরাদনগর উপজেলার রহিমপুর হেজাজিয়া এতিমখানায় গিয়ে দেখা গেছে ওই প্রতিষ্ঠানে ৫৬৫ জন দুস্থ অসহায় শিশু শিক্ষা গ্রহণ করছে। কিন্তু মাত্র ২৬০ জন শিশু ২ হাজার টাকা করে সরকারি বরাদ্দ পাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটিতে সরকারি ক্যাপিটেশনের সাইনবোর্ড থাকায় স্থানীয়ভাবেও কোনো অনুদান মিলছে না। এতে স্বল্প বরাদ্দে প্রতিষ্ঠানের নিবাসীরা খরপোষ জোগাড় করতে পারছে না। এতিমখানার প্রধান শিক্ষক মাওলানা আমির হোসাইন বলেন, 'আমাদের এতিমখানার শিশুরা চরমভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। সরকার সবধরনের বরাদ্দ দিচ্ছে মনে করে সাধারণ লোকজনও অনুদান দিচ্ছে না। এতে আমরা খুব কষ্টে আছি।'
জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলার কোটবাড়ী জামিয়া মোহাম্মদীয়া শিশু সদন কমপেস্নক্সে ২৫০ জন নিবাসী শিক্ষাগ্রহণ করছে। প্রতিষ্ঠানটিতে সরকারি ক্যাপিটেশন পাচ্ছে ৮৩ জন। তাও প্রতিজন মাত্র দুই হাজার টাকা। এতে ওই প্রতিষ্ঠান চালাতে চরম হিমশিম খাচ্ছেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবু তাহের। তিনি জানান, 'সরকার অনুদান দিচ্ছে মনে করে আমরা সাধারণ দাতাদের কাছ থেকেও কোনো প্রকার অনুদান পাচ্ছি না। এখন এসব নিবাসীদের নিয়ে বড় বেকায়দায় পড়েছি।'
চট্টগ্রামের তানজীমুল মুসলিমিন এতিমখানা ও হেফজখানার পরিচালক হাফেজ মুহাম্মদ আমানুলস্নাহ জানান, 'সরকারি বরাদ্দ ২ হাজার টাকা দিয়ে কোনোভাবেই একজন নিবাসীর মাসব্যাপী খরচ চলে না। শিক্ষক, কর্মচারী, পিয়ন, ঝাড়ুদারদের কোনো প্রকার সরকারি বরাদ্দ দেওয়া হয় না। তাছাড়া বিদু্যৎ এবং গ্যাস বিল পাচ্ছি না।'
বাংলাদেশ বেসরকারি এতিমখানা কল্যাণ পরিষদের সভাপতি হাফেজ বাশারত ভুঁইয়া বলেন, 'নিবাসী হিসেবে সরকারি এতিমখানায় থাকলে দেওয়া হয় ৪ হাজার টাকা বরাদ্দ। আর বেসরকারিতে থাকলে দেওয়া হয় ২ হাজার টাকা। এটা স্পষ্ট বৈষম্য। আমাদের দুস্থ অসহায় নিবাসীরা এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে দ্রম্নত পদক্ষেপ গ্রহণ করে সমাধান দেওয়া।
সাধারণ সম্পাদক কাজী মো. লোকমান বলেন, 'আমাদের প্রতিষ্ঠানসমূহে কম্পিউটার অপারেটর এবং প্রয়োজনীয় অ্যাক্সেসরিজ নেই। হঠাৎ করে ডাটা এন্ট্রি নামে নতুনভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে। নিবাসীদের প্রয়োজনীয় খরপোষ বহন করতেই কষ্ট হয়। তার মধ্যে নতুন করে ডাটা এন্ট্রিসহ নতুন নতুন নীতিমালার যাতাকলে ফেলা হচ্ছে। এতে এসব প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে।'
কুমিলস্নার সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে ডাটা এন্ট্রি পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এতিমখানাগুলোতে কম্পিউটার, প্রয়োজনীয় অ্যাক্সেসরিজ এবং অপারেটর নেই এটা সত্য। সে ক্ষেত্রে তাদের কিছুটা বিড়ম্বনা পোহাতে হচ্ছে। তারপরও এসব প্রতিষ্ঠানকে আমরা ডাটাবেজের আওতায় আনার চেষ্টা করছি। প্রতিষ্ঠানগুলোর নানা প্রতিবন্ধকতা এবং বৈষম্য দূর করতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।