'ও ভাই খাটি সোনার চেয়ে খাটি, আমার দেশের মাটি' বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের গানের এ কলিটি বাস্তবে রূপ দিয়েছে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার মুরারিকাটি গ্রামের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে। এখানকার মাটি বিক্রি হচ্ছে সোনার দামে। কুমারহসম্প্রদায় ১৮ প্রকারের মাটির তৈরি বিভিন্ন ডিজাইনের টালি ও লাইলস্ বিদেশে রপ্তানি করে প্রতিবছর ১৫০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে এখানকার মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িতরা। এতে একদিকে যেমন সরকার লাভবান হচ্ছে, অনদিকে স্বাবলম্বি হচ্ছে কারখানার মালিক, শ্রমিক ও রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীরা।
তবে নানা প্রতিকূলতা, সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজির কারণে সম্প্রসারিত হচ্ছে না এই মৃৎশিল্প। দেশের উজ্জল সম্ভাবনাময় এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের পৃষ্টপোষকতার বিকল্প নেই বলে মনে করেন কারখানার মালিক, শ্রমিক ও বিভিন্ন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এবং চেম্বার অব কর্মাস।
সরেজমিনে দেখা গেছে কংক্রিট এবং টাইলসকে পেছনে ফেলে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার মুরারীকাটি গ্রামের মাটির তৈরি টালি এখন বিশ্ব বাজারে জায়গা করে নিয়েছে। এখানকার কাঁদা-মাটি দিয়ে নিপুন হাতের ছোঁয়ায় শৈল্পিকভাবে তৈরি করা আগুনে পোড়ানো মাটির বিভিন্ন ডিজাইনের টালি এখন জাহাজে করে সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে রপ্তানি হচ্ছে ইটালি, জার্মানি, জাপান, দুবাই, মালেএশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিন আফ্রিকা, ফ্রাস, আমেরিকা, ইউরোপসহ বিশ্ব বাজারের বিভিন্ন দেশে। বিশেষ আকৃতির ছাচে ফেলে হাতদিয়ে তৈরি কাঁদা-মাটির এ টাইলস্ ও টালি ইউরোপবাসীদের শুধু নজর কাড়েনি, ঘুরিয়েছে দেশের অর্থনীতির চাকাকেও। এ টালি রপ্তানি করে বছরে আয় হচ্ছে কয়েক কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। ফলে বদলে গেছে সাতক্ষীরার কুমার সম্প্রদায়ের জীবনও। এখানকার প্রায় ৯০ শতাংশ পরিবার এখন স্বনির্ভর ও স্বাবলম্বি।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারী পৃষ্টপোষকতার অভাবে মৃৎশিল্পের সম্প্রসারণ যথাযথ ভাবে হচ্ছে না। ২০০২ সালের পর এই টাইলস তৈরি শুরু হয়। সে সময়ে ৪১টি কারখানা থাকলেও এখন টিকে আছে মাত্র ১২টি। মুরারিকাটিতে মাটিতে তৈরি উৎপাদিত টালির মধ্যে ফেক্স এ্যাংগুলার, হেড ড্রাগুলার, স্কাটিং, স্টেম্প, স্কয়ার, রূপ, ব্রিকস্ ও ফ্লোর টালি রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান জেকে ইন্টাররন্যাশনাল, নিকিতা ইন্টারন্যাশনাল, মা-কটোস্ ইন্টারন্যাশনালসহ ১০ থেকে ১২টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মুরারিকাটিতে উৎপাদিত টালি ইউরোপ-আমেরিকায় রপ্তানি করছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, আধুনিক প্রযুক্তির পাশাপাশি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এবং সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি বন্ধ হলে দেশের রপ্তানিতে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে মুরারিকাটির টালি।
জানা যায়, পাকিস্থান আমল হতে এখানকার কুমারসম্প্রদায় ঘরের ছাউনিতে ব্যবহার উপযোগী কাদা মাটি দিয়ে টালী তৈরি করত। আর তাদের তৈরি টালী ব্যবহার হতো নিম্ন ও মধ্যেবিত্তদের ঘরের ছাউনি হিসেবে। কিন্তু কালের আবর্তনে আজ সেই মাটির টালি, সৌর্ন্দয্যবর্ধন করতে ব্যবহারিত হচ্ছে বিদেশীদের বড় বড় অট্টালিকার ছাদে, ফ্লোরে, সিড়িতে, দেয়ালে, বেলকুনি, মেঝে ও ঘর সাজানোর কাজে।
মুরারীকাটি গ্রামের রপ্তানিজাত টালি উৎপাদনের প্রতিষ্ঠাতা ও কলারোয়া টালি কারখানা মালিক ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোষ্ঠ চন্দ্র পাল জানান, বাংলাদেশের গাজীপুরের রুহুল আমিনের গাজিপুরের মডান ব্রিক্স ফিল্ড নামে একটি কারখানা ছিল। তিনি বিদেশে বায়ারদের কাছে প্রথম টালি রপ্তানির অর্ডার পান। কিন্তু মাটি ভালো না হওয়ায় ১০০টি টাইলস্ তার কারখানার আগুনে পোড়ানো হলে নষ্ট হতো ৮০টি লচের মুখে পড়ে তিনি টালি কোথায় তৈরি হয় সন্ধান করতে থাকেন। এক পর্যায়ে কলারোয়ার একজন রিকশা চালকের সঙ্গে ঢাকায় পরিচয় হয়। তার মাধ্যমে কলারোয়ার মুরারিকাটি গ্রামের টালি তৈরি কারখানার সন্ধান পান। পরে রুহুল আমিনের মাধ্যমে ২০০০ সালে সাতক্ষীরার কলারোয়ার মুরারিকাটি গ্রামের টালি তৈরির কারখানায় আসেন ইটালিয়ান নাগরিক রাফাইলি আলদো। তিনি দোআষ মিষ্টি মাটি দিয়ে তৈরিকৃত টালি পছন্দ করেন। প্রথমে ২০০২ সালে কড়ি বর্গার ছাদে ব্যবহৃত ১২ বাই ১২ ইঞ্চি মাপের পরীক্ষামূলক ১২টি টালি ইটালিতে নিয়ে যান। এর পর থেকে মুরারিকাটির টালি ইটালি শহরে রপ্তানি শুরু হয়। আর সে বছরই তিনি কনটেইনারের মাধ্যমে খুলনার মোংলা বন্দর দিয়ে জাহাজে করে প্রথম টালি রপ্তানি শুরু করেন ইটালীতে। আর তখন থেকে মুরারিকাটি গ্রামের পরিচিতি পায় ইটালি নগর হিসেবে। এরপর পুরোদমে রপ্তানি হতে থাকে ২০০৪ সাল থেকে।
খুলনার জে.কে ইন্টারন্যাশনাল, আরনো এক্সপোর্ট ইমপোর্ট, জেকে ইন্টাররন্যাশনাল, নিকিতা ইন্টারন্যাশনাল, মা-কটোস্ ইন্টারন্যাশনালসহ ১০ থেকে ১২টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মুরারিকাটিতে উৎপাদিত টালি ইউরোপ-আমেরিকায় রপ্তানি করছে। দেশের বড় বড় আমদানি-রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বিদেশে পাঠাতে থাকে তাদের পছন্দমত তৈরীকৃত বিভিন্ন আকৃতির টালি ও টাইলস। এখন এই টালি ইটালী ছাড়াও আমেরিকা, স্পেন, ফ্রান্স, দক্ষীন আফ্রিকা, মালেএশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন বাজারসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বছরে প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকারমত বৈদেশিক মুদ্রা উপার্যিত হচ্ছে। ফলে দুঃখে দুর্দশায় থাকা কুমারদের জীবন যাত্রার মানও বদলে গেছে।
সাতক্ষীরার প্রাকৃতিক পন্যের এক নন্বর অর্থকারী খাত হিসাবে টালি ইউপের বাজার দখল করায় কলারোয়ার মুরারিকাটি, মির্জাপুর ও শ্রীপতিপুর গ্রামে প্রথম দিকে ৪১টি টালি তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছিল। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়া, সিন্ডিকেট ও করোনাকালিন সময়ে বিদেশে টালি রপ্তানি বন্ধ থাকায় ২৯টি কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়ে মৃৎশিল্প। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় কারখানাগুলো আবার চালু হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারনে টালির নায্যমূল্য পাচ্ছেন না তারা। এর পর গত ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নতুন করে শুরু হয়েছে চাঁদাদাবাজি। ফলে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ও টালি কারখানার মালিকরা পড়েছে চরম বিপাকে।
কলারোয়া টালি ঘর কারখানার মালিক আবুল হোসেন জানান, এ সমস্ত কারখানায় বিভিন্ন স্থান থেকে প্রথমে সুন্দর এটেলে দোয়াশ মিষ্টি মাটি সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। পরে পানি দিয়ে পায়ের মাধ্যমে শ্রমিকরা কাদার মন্ড তৈরি করেন। পরে বিশেষ আকৃতির ছাচে ফেলে তৈরি হয় বিভিন্ন আকৃতির টাইলস ও টালি। সূর্যের আলোয় শুখিয়ে রঙে চুবিয়ে আবার শুকিয়ে বিশেষ ব্যাবস্থাপনায় আগুনে পুড়িয়ে নির্মাণ হয় উন্নতমানের টা্ইলস ও টালি। এ অঞ্চলের এখন ১২টি কারখানায় ১ হাজারেরমত নারী ও পুরুষ শ্রমিক নিয়মিত কাজ করে থাকেন। বর্ষা ছাড়া বছরে ৭ থেকে ৮ মাস এখানে টালি তৈরির কাজ হয়। এদের দৈনিক মজুরী ২৫০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত। টালী উৎপাদনকে ঘিরে এলাকার অনেক অসচ্ছল ও বেকার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।
টালি তৈরির শ্রমিক আব্দুর রশিদ বলেন, মুরারিকাটির মাটি মিষ্টি মাটি। এই মাটি সোঁনার চাইতে খাঁটি। এখানকার মাটি এত খাঁটি এখন বিদেশে সোনার মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। মাটি বিদেশে রপ্তানির কারনে এসব কারখানায় এক সময় ৩ থেকে ৪ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছিল।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টালি আমদানি কারক প্রতিষ্ঠান 'জে.কে. ইন্টারন্যাশনাল'র সিইও জাকির হোসেন বলেন, কলারোয়ার মুরালিকাটির মাটির টালি বিশ্বমানের। যার জন্য গোটা দুনিয়ার মার্কেট দখল করতে পেরেছি। এটার বড় বাজার ইটালিতে। যার জন্য এই কলারোয়াকে ইটালির শহর বলা হয়ে থাকে। এছাড়া, আরব আমিরাত, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, তোর্কি ও ব্রিটেনের লন্ডনে আমরা রপ্তানি করে থাকি।
সাতক্ষীরা চেম্বার ওফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি নাছিম ফারুক খান মিঠু জানান, 'সাতক্ষীরার মৃৎশিল্প একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। এ শিল্প থেকে উৎপাদিত বছরে ১০ থেকে ১২ কোটি টালি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। বছরে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার মতো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। কিন্তু সরকারী পৃষ্টপোষকতার অভাবে মৃৎশিল্প যথাযথ ভাবে সম্প্রসারণ হচ্ছে না। ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে টালি কারখানা মালিকদের বিভিন্ন জটিলতার শিকার হতে হয়। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির সঙ্গে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার করতে না পারাসহ বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টিতে সরকারের সহযোগিতার অভাব এবং কিছু ব্যবসায়ীর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে মুরারীকাটির বিখ্যাত টালি শিল্প। এই শিল্প সম্প্রসারণে কারখানা মালিকদের সরকার সহযোগিতা দিলে সাতক্ষীরার উজ্জল সম্ভাবনাময় টালি শিল্পটি ভবিষতে বাংলাদেশের রপ্তানি বানিজ্যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে আরও বেশি গুরত্বপূর্ন ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) সাতক্ষীরার উপ-ব্যবস্থাপক গৌরব দাস বলেন, বিসিকের পক্ষ থেকে এই শিল্প এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে। তাদের সব ধরনের আর্থিক এবং কারিগরি সহযোগিতা করতে প্রস্তুত বিসিক।