বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২

গুণে-মানে অনন্য কাপ্তাই হ্রদের শুঁটকির চাহিদা দেশজুড়ে বাড়ছে

সাকিব আলম মামুন, লংগদু (রাঙামাটি)
  ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
গুণে-মানে অনন্য কাপ্তাই হ্রদের শুঁটকির চাহিদা দেশজুড়ে বাড়ছে
গুণে-মানে অনন্য কাপ্তাই হ্রদের শুঁটকির চাহিদা দেশজুড়ে বাড়ছে

মাছের প্রাচুর্যের এ সময়ে বাড়তি মাছ শুঁটকি করার চল শুরু হয়। এ সময় মৎস্য ভান্ডার খ্যাত কাপ্তাই হ্রদজুড়ে শুঁটকি তৈরির ধুম পড়ে গেছে। শতাধিক চাতালে শুরু হয়েছে শুঁটকি উৎপাদনের কাজ। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। এই হ্রদ বেষ্টিত এলাকায় প্রতি বছরের মতো এবারও শুরু হয়েছে দেশীয় জাতের মাছের শুঁটকি উৎপাদন প্রক্রিয়া।

ভরা মৌসুমে কাপ্তাই হ্রদের কাট্টলী বিল, মাইনী, মাহিল্যা, রাঙামাটি বিল, বরকলের শুবলং চ্যানেল ও ছোট হরিণাসহ উলেস্নখযোগ্য কয়েকটি স্থানে প্রচুর মাছ ধরা পড়ে। ব্যবসায়ী ও জেলেরা বিল থেকে মাছ ধরে বা কিনে চাতাল কিংবা নিজ বাড়ির আঙিনায় শুকিয়ে শুঁটকি করেন। অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে শুঁটকি তৈরি শুরু হয়। প্রতিটি ছোট-বড় চাতালে নারী-পুরুষ মিলে ৫-১০ জন শ্রমিক কাজ করেন। এ কাজে নারী শ্রমিকরাই বেশি দক্ষ। পার্বত্যাঞ্চলে শুঁটকি তৈরি শুরু হলেও বাজারজাত করতে আরও মাসখানেক সময় লাগবে। শহর কিংবা বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা এসে শুঁটকি কিনে নিয়ে যায়। আবার কেউ কেউ স্থানীয় বাজারে খুচরা মূল্যেও এসব শুঁটকি বেচাকেনা করে থাকেন।

শুঁটকি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, প্রতি মণ কাঁচা মাছ ৩-৮ হাজার টাকা দরে কেনা হয়। প্রতি ৩ কেজি কাঁচা মাছ থেকে শুঁটকি তৈরি হয় প্রায় ১ কেজি। শুঁটকি মাছ প্রকারভেদে ১০-২০ হাজার টাকা মণ দরে পাইকারি বিক্রি করা হয়। আর খুচরা বিক্রির বিষয়টি নির্ভর করে স্থানীয় বাজার ও ক্রেতাদের চাহিদার ওপর।

এ অঞ্চলের শুঁটকি চাতালে দেশি প্রজাতির মাছের শুঁটকি তৈরিতে সকাল থেকে রাত অবধি মাছ কেনা, ধোয়া, চাতালে শুকানো এবং মান ও প্রকারভেদে বাছাই করে পৃথক করার কাজ করছেন স্থানীয় নারী-পুরুষরা।

এলাকার অর্ধশতাধিক নদীনালা, খাল-বিলে প্রচুর পরিমাণে কাঁচকি, চাপিলা, পুঁটি, কৈ, মাগুর, বাঁচা, রুই, কাতলা, মৃগেল, বাউশ, আইড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। বর্ষাকালে মাছ ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠিয়ে দেন জেলেরা। দেশের বিভিন্ন মোকামে ঢাকা, চট্টগ্রাম পাঠানো হয় এসব শুঁটকি মাছ। এছাড়াও দেশের উত্তরাঞ্চলে কাপ্তাই হ্রদের ছোট মাছ ও শুঁটকির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তার মধ্যে জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, রংপুর, বগুড়া, দিনাজপুর উলেস্নখযোগ্য।

জেলে আলী আকবর, শাহ আলম, আবুল বশর জানান, শুকনা মৌসুমে তারা ক্ষেতে-খামারে কাজ করেন। বর্ষায় কাজ না থাকায় রাত-দিন কাঁচকি জাল দিয়ে হ্রদের বিভিন্ন অংশে মাছ শিকার করেন। অনেকে মাছ শিকারের পর ট্রলারে বিক্রি করেন। আবার কেউ মালিক পক্ষ থেকে অগ্রিম টাকা নেওয়ায় ঋণ শোধ করতে তাদের কাছেই পৌঁছে দেন মাছ। সেই মাছের কিছু যায় আড়তে, আর কিছু যায় শুঁটকির চাতালে।

শুঁটকি ব্যবসায়ী সানোয়ার ও বিলস্নাল বলেন, এ ব্যবসায় অনেক লাভ। দেশব্যাপী কাপ্তাই হ্রদের কাঁচা মাছের যেমন চাহিদা রয়েছে, ঠিক তেমনি শুঁটকির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কাপ্তাই হ্রদের শুঁটকি অন্যান্য অঞ্চলের শুঁটকির চেয়ে তুলনামূলক স্বাদে, গুণে-মানে ভরপুর। ধীরে ধীরে পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে হ্রদ এলাকায় এ বছর টেংরা, পুঁটি, চেলা, মলা, ঢেলা, টাকি, চিংড়ি, চিতল, শিলং, রুই, কাতলাসহ বিভিন্ন ধরনের মাছ পাওয়া যাচ্ছে। এখন মাছের দাম কিছুটা কম থাকায় সবাই শুঁটকি তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

বিএফডিসি রাঙামাটি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ বছর পোনা নিধন অভিযান জোরদার এবং বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা স্থায়ী হওয়ায় মাছের প্রাচুর্য বেড়েছে। যে কারণে কাপ্তাই হ্রদে এবার মাছের উৎপাদন আগের তুলনায় বেড়েছে। এ বছর শুঁটকি উৎপাদন আরও বাড়বে। মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

পার্বত্য জেলার লংগদু উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তানবীর আহসান বলেন, বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির আওতায় লংগদু উপজেলায় শুঁটকি উৎপাদনের নির্ধারিত কোনো লক্ষ্যমাত্রা নেই। তবে উপজেলা মৎস্য দপ্তর থেকে শুঁটকি উৎপাদকদের নিয়মিত কারিগরি সহায়তা দেওয়া হয়। এরমধ্যে নিবন্ধিত জেলেরা শুঁটকি উৎপাদনে আগ্রহী হলে মৎস্য অধিদপ্তরের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মৎস্যসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের 'নিবন্ধিত জেলেদের বিকল্প আয়বর্ধক কার্যক্রম'র আওতায় নিরাপদ শুঁটকি উৎপাদনের উপকরণ বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

তিনি আরও জানান, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লংগদুতে শুঁটকি উৎপাদনের মাত্রা ছিল ৬২.৩৪ মেট্রিক টন।

বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন রাঙামাটির ব্যবস্থাপক কমান্ডার আশরাফুল আলম ভূঁইয়া জানান, পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শুঁটকি উৎপাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৩৮ মেট্রিক টন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চলতি নভেম্বর মাস পর্যন্ত শুঁটকি উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ১৯১ মেট্রিক টন, যা মৌসম শেষে গত বছরের অর্জিত মাত্রা অতিক্রম হবে বলে আশা করা যায়।

প্রসঙ্গত, রাঙামাটি জেলার দশ উপজেলায় মৎস্য অধিদপ্তরের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মৎস্যসম্পদ উন্নয়ন করপোরেশনের আওতায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ২৬ হাজার ৭৫১ জন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে