ময়মনসিংহের ত্রিশালে এআই পদ্ধতিতে চাষ করা হচ্ছে মাছ -যাযাদি
বাংলাদেশে মাছ উৎপাদনে শীর্ষ উপজেলা হিসেবে সুনাম রয়েছে ত্রিশালের। এ উপজেলার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মাছ উৎপাদন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। দুই যুগের বেশি সময় ধরে এ উপজেলার তরুণ-যুবক থেকে সব ধরনের ব্যবসায়ী মাছ চাষে সফলতা দেখলেও গত কয়েক বছরে গুনতে হচ্ছে লোকসান। খাদ্যের দাম বৃদ্ধি, জমি ভাড়া, গুণগত মানের সমস্যা ও মাছ বৃদ্ধির নানা প্রতিবন্ধকতায় ব্যবসায়ীদের ক্ষতির অন্যতম কারণ। এ থেকে চাষিদের রক্ষা ও চতুর্থ শিল্প বিপস্নবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মাছ চাষ শিল্পে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়াতে হবে। আর অল্প জমিতে উৎপাদন বৃদ্ধি ও অপচয় রোধ করে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে চাষিদের লোকসানের হাত থেকে রক্ষা করতে উদ্ভাবন করা হয় এআই (আর্টিফিয়াল ইন্টেলিজেন) নামের প্রযুক্তি।
গত সাত মাসে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাওয়া যায় এক বৈপস্নবিক সফলতা। এতে উপজেলার উৎপাদিত মাছের খরচ কমবে প্রায় দেড়শ' কোটি টাকা ও জমির অপচয় কমবে প্রায় দুইশ' হেক্টর।
উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, ত্রিশাল উপজেলার তিন হাজার ২৮৬ হেক্টর জমিতে ছোট-বড় প্রায় পঁচিশ হাজার পুকুরে চাষ হয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এর মধ্যে ৭০ ভাগ উৎপাদন হয় পাঙাশ মাছ। প্রায় ৯ হাজার মৎস্য চাষি প্রতিবছর মাছ উৎপাদন করে গড়ে ৭০ হাজার মেট্রিক টন। এই মাছ উৎপাদনে চাষিদের ব্যয় আটশ' কোটি টাকার বেশি। এত টাকা ব্যয় করে উৎপাদিত মাছ বিক্রি করেও চাষিরা ন্যায্য লাভের মুখ দেখেন না। বড় চাষিরা তাদের পুঁজি খাটিয়ে লাভের মুখ দেখলেও ক্ষুদ্র চাষিরা লোকসান গোনেন। তাই অনেকেই এ ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। যার অন্যতম কারণ অক্সিজেন সমস্যায় মাছের মড়ক, পানির বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গুণগত মান ঠিক না রাখতে পারা, মাছের খাবার পরিমাণ নির্ণয় না করে খাদ্যের অপচয় রোধ করতে না পারা অন্যতম।
ত্রিশাল উপজেলার প্রশাসনের উদ্যোগে এই সমস্যার সমাধানে তৈরি করা হয় এআই পদ্ধতি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক ইন্টারনেট অব থিংক্সস (আওটি) ব্যবহার করে সেন্সর ইউনিট, অক্সিজেন সেন্সর, পিএইচ সেন্সর, টিডিএস, টেম্পারেচার সেন্সর, আরপি সেন্সর, ফুড সেন্সর, ওয়াটার লেভেল সেন্সর, এমুনিয়াটা সেন্সরের সমন্বয়ে একুয়া কালচার ৪.০ প্রযুক্তি নামে সফটওয়ার পেইজ সার্বক্ষণিক পুকুরের তথ্য সংগ্রহ করে এআই'র মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমস্যা সমাধান করবে। চাষিদের সুবিধার্থে সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের জন্য নেক্সাস ফিস নেটওয়ার্ক নামে এক মোবাইল অ্যাপস তৈরি করা হয়। যার মাধ্যমে একজন চাষি ঘরে বসেও তার পুকুরে উৎপাদিত মাছের সার্বক্ষণিক চাহিদা, সমস্যা সমাধান করতে পারবে। আর এ প্রযুক্তির মাধ্যমে সমপরিমাণ জমিতে আরও ৬ গুণ মাছ উৎপাদন করা যাবে।
উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে চলতি বছরের এপ্রিলে কানিহারী ইউনিয়নের সরকারি এক পরিত্যক্ত পুকুরের ৫৮ শতাংশ জমিতে ৫৫ গ্রামের ৬৫ হাজার পাঙাশ পোনা দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে এআই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যেখানে গতানুতিক চাষের বিপরীতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে খাবার প্রদানের ৪টি যন্ত্র রয়েছে। অক্সিজেন সরবরাহ চাহিদা অনুযায়ী পূরণের জন্য স্থাপন করা হয়েছে ৮টি এয়ারেটর যন্ত্র। যা দিয়ে অক্সিজেনের অভাবে মাছের মড়করোধ ও চাহিদা অনুযায়ী খাবার গ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। এ পদ্ধতি ব্যবহারে গত সাত মাসে মাছের ওজন হয়েছে ১২০০ গ্রাম ও প্রতি পিস মাছে খরচ হয়েছে ১০৫ টাকা।
মৎস্য চাষি ইদ্রিস আলী বলেন, 'আমরা সাধারণত ৫৮ শতাংশ জমিতে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১১ হাজার মাছ উৎপাদন করে থাকি। ৫০ থেকে ৬০ গ্রামের একটি মাছ কেজিতে আনতে আমাদের খরচ হয় ১১০ থেকে ১১৫ টাকা। আর যদি খাদ্য ও পানির গুণগত মান, স্বাভাবিক অক্সিজেন সরবরাহ ব্যাহতের কারণে মাছের বৃদ্ধি কমে তাহলে এই ব্যয় দাঁড়ায় ১২০ টাকায়। এআই পদ্ধতি ব্যবহার করে স্বাভাবিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করা গেলে প্রতি কেজি মাছে উৎপাদন খরচ কমবে ১০ থেকে ১৫ টাকা। আর একই পরিমাণ জমিতে ৬ গুণ মাছ উৎপাদন সম্ভব।'
অপর এক চাষি জাকির হোসেন বলেন, 'আমরা পুকুরে মাছ ছেড়ে সেই অনুযায়ী প্রতি পিস মাছের চাহিদা অনুযায়ী প্রতি গ্রাম হিসেবে খাবার দেই। এতে ভাসমান খাবারের ক্ষেত্রে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ গ্রোথ প্রত্যাশা থাকে। আর ডুবন্ত খাবারের ক্ষেত্রে যা নামে ৪০ থেকে ৫০ ভাগে। এআই পদ্ধতিতে মাছের চাহিদা অনুযায়ী খাবার দেওয়া গেলে অপচয় রোধ হবে ১০ থেকে ১৫ ভাগ। একজন চাষি এতে অনেক বেশি লাভবান হবেন।
এআই পদ্ধতিতে মাছ চাষ প্রকল্পের কারিগরি পরামর্শক রনি সাহা বলেন, অত্যাধুনিক অ্যাকুয়া কালচার ৪.০ প্রযুক্তি ও বিদ্যমান পুকুরে ভার্টিক্যাল এক্সপানশন পদ্ধতির সমন্বিত ব্যবহারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে একজন চাষি প্রতিনিয়ত তার পুকুরের অক্সিজেন লেভেল, কাদার পরিমাণ, পানির দূষণ সার্বক্ষণিক আপডেট পাবে। প্রতিষেধক যন্ত্র ব্যবহার করে এআই নিজেই এ সমস্যা সমাধান করবে। তাছাড়া মাছের যতটুকু খাবারের চাহিদা শুধু তা গ্রহণের পরই স্বয়ংক্রিয়ভাবে খাবার বন্ধ হয়ে যাবে। সময় ও চাহিদা অনুযায়ী মাছ আবার তার খাবার গ্রহণ করবে। আর এই প্রযুক্তি ব্যবহারে একজন চাষির অতিরিক্ত ৩ থেকে চার লাখ টাকা ব্যয় হলেও সঠিকভাবে ব্যবহার করে আমাদের পাইলট প্রকল্পের অংশটুকু থেকে সাশ্রয় হয়েছে ১৫ লাখ টাকা। এতে মাছের দাম কম বা খাদ্যের দাম স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকলেও একজন চাষিকে লোকসান গুনতে হবে না।
এ পদ্ধতি ব্যবহারের উদ্ভাবক ও ত্রিশাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জুয়েল আহমেদ বলেন, ত্রিশাল উপজেলার অধিকাংশ মানুষ এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। তবে তাদের সমস্যার শেষ নেই। বিশেষ করে এত পুঁজি ব্যবহার করে লাভের মুখ না দেখে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। মাছ চাষে সমৃদ্ধ এ উপজেলার এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে এআই পদ্ধতি পরীক্ষামূলক ব্যবহারে আমরা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সফলতা পেয়েছি।