বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১০ বৈশাখ ১৪৩২

লবণ উৎপাদনে মাঠে কক্সবাজারের চাষিরা

জাবেদ আবেদীন শাহীন, কক্সবাজার
  ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
লবণ উৎপাদনে মাঠে কক্সবাজারের চাষিরা
কক্সবাজারে লবন তৈরির কাজে ব্যস্ত চাষি -যাযাদি

কক্সবাজারে শুরু করেছেন লবণ উৎপাদন প্রান্তিক চাষিরা। চলতি মৌসুমেই কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও, চকরিয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, টেকনাফ ও বাঁশখালীর প্রায় ৩৮ হাজার লবণচাষি মাঠে নেমেছেন। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিকের) তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে দেশে লবণের চাহিদার ৮০ ভাগই মেটানো হয়।

এবার জেলায় প্রায় ৭০ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ হচ্ছে। লবণ উৎপাদনের নতুন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। গত বছর ৬৮ হাজার ৫০৫ একর জমিতে লবণ উৎপাদিত হয়েছিল ২৪ লাখ ৩৮ হাজার মেট্রিক টন, যা বাণিজ্যিক লবণ উৎপাদন শুরুর পরবর্তী ৬২ বছরের সর্বোচ্চ রেকর্ড। এবারও শতভাগ জমিতে পলিথিন প্রযুক্তিতে ব্যবহার হচ্ছে। এ বিষয়ে চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সনাতন পদ্ধতির তুলনায় পলিথিন প্রযুক্তিতে লবণ উৎপাদন আড়াই গুণ বেশি হয়। জেলার ৪৪ হাজার প্রান্তিক চাষি, ১ লাখ শ্রমিকসহ অন্তত ১০ লাখ মানুষ লবণ উৎপাদন, বিপণন, পরিবহন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

তবে সবকিছু নির্ভর করছে আবহাওয়ার ওপর। ঝড়-বৃষ্টি না হলে লবণ উৎপাদন ২৬ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যেতে পারে। দেশে লবণের বার্ষিক চাহিদা নির্ধারণ হয়েছে ২৫ লাখ ৫০।

জাতীয় অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রেখে যাচ্ছে লবণ শিল্প। কয়েক হাজার মানুষ এ শিল্পে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে জড়িত। লবণ শিল্পের উন্নতির ফলে আমদানির উপর নির্ভরশীলতা কমেছে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ হচ্ছে। লবণ চাষ মুলত উপকূলীয় অঞ্চলে হওয়ায় এ শিল্প ওই এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

জেলার উপকূলীয় এলাকায় এখন লবণ উৎপাদন মৌসুম শুরু হয়েছে। চলতি মৌসুমে মাঠে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় খুশি না হলেও পরবর্তীতে বাড়বে। চলতি ২০২৪-২০২৫ মৌসুমে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। লবণ উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের অন্তরীণ চাহিদা পূরণ হচ্ছে, যা আমদানির উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে অর্থনীতিকে স্বাবলম্বী করেছে। মাঠপর্যায়ে এক মণ লবণের দাম ৩শ' টাকা থেকে ৩৫০ টাকা। অথচ এর উৎপাদন খরচই পড়ছে ৩শ' বেশি হওয়ায় বিপাকে প্রান্তিক চাষিরা।

মহেশখালীর লবন চাষি আবুল হোসেন বলেন, 'এবার লবণের দাম অনেক কম হওয়ায় মাঠ থেকে মজুরি খরচ তুলতে পারব কিনা ভয় করছে। যেহেতু ঘামের শ্রমের অর্জিত লবণ, যদি লাভের মুখ দেখতে না পারি তাহলে আমাদের আত্নহত্যা ছাড়া কোনো পথ থাকবে না।'

মুলত কিছু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী শুরুতে দাম কমিয়ে চাষিদের লবণ উৎপাদনে নিরুৎসাহিত করছেন। যাতে লবণ সংকট দেখিয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করা যায়।

বিশেষজ্ঞরা জানান, এক সময় সনাতন পদ্ধতি ব্যবহারে পরিমাণ সামুদ্রিক নোনা পানি তিনটি ধাপে ছয় থেকে সাত দিন ধরে লবণ চাষ করা হতো। সেময় উৎপাদিত লবণে মাটি লেগে থাকত। এতে করে লবণের রঙ থাকত বাদামি। তবে এখন সময়ের পরিক্রমায় আধুনিক পদ্ধতিতে চাষের ফলে রেকর্ড পরিমান লবণ উৎপাদন হচ্ছে। মাঠে উন্নত প্রযুক্তি সেচ পাম্প ও নলকূপ ব্যবহারে খুব সহজে লবণাক্ত পানি উত্তোলনে কম খরচে, অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপক লবণ উৎপাদিত হয়।

প্রান্তিক লবণ চাষিদের অভিযোগ, ঘাম ঝরানো শ্রমের বিনিময়ে উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল্য থেকে প্রতিবার বঞ্চিত হচ্ছেন। মৌসুম শুরু হলে দেশে এক শ্রেণির লবণ মিল মালিক সরকারকে ভুল বুঝিয়ে বিদেশ থেকে আমদানীর পায়তারা করেন। ফলে উৎপাদনের মাঝপথে চাষিদের মধ্যে আগ্রহ কমতে থাকে। তাছাড়া লবণ শিল্প ঘিরে তাদের অনেক দাবিও পূরণ না হওয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে।

ভারূয়াখালী এলাকার লবণ চাষি মহিবুলস্নাহ, ইসমাইল, সুলতান আহম্‌দ জানান, চৈত্র মাস হলো লবণের জন্য লবণ চাষের জন্য সঠিক সময়। কিন্তু সিন্ডিকেট চক্র কর্তৃক বিদেশ থেকে লবণ আমদানির কারণে পরপর বেশ কয়েক মৌসুম চাষিরা বিপুল পরিমাণ লবণ উৎপাদন করেও লোকসান গুণতে হয়েছে। আবহাওয়া ভালো থাকলে এক কানিতে ১২০ মণ পর্যন্ত লবণ উৎপাদন হয়। তবে দাম নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।

সরেজমিনে বেশ কিছু লবণ মাঠ ঘুরে জানা যায়, চলতি মৌসুমে প্রথম লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে। লবণ চাষের ভরা মৌসুম হচ্ছে ফাল্গুন-চৈত্র মাস হলেও আরও চার মাস লবণের ভালো উৎপাদন হয়। কক্সবাজারের মহেশখালী, খুরশকুল, ভারুয়াখালী ও চৌফলদন্ডীতেও লবণ উৎপাদনের প্রস্তুতি দেখা গেছে। মাঠে নিরলস কাজ করছেন চাষিরা। কেউ লবণের বেড সমান করছেন, কেউ পানি দিচ্ছেন আর কেউ বিছানো কাগজে ফোটা 'সাদা সোনা' বেডের অদূরেই লবণ জমানোর গর্তে ফেলছেন। মাঠে কাজ করা চাষিরা জানান, এখনো লবণের দাম কম, তবে আগামী লবণ চড়া দামে বিক্রি করতে পারবেন। যদিও চলতি নভেম্বর গত বছরের তুলনায় লবণের দাম অনেক কম হলেও মৌসুম ভালো হলে লবণের ন্যায্য দাম পাবেন বলে আশাবাদী তারা।

এবার কুতুবদিয়ায় ৭০ শতাংশ, পেকুয়ায় ৫০ শতাংশ, টেকনাফে ১০ শতাংশ ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় ৪০ শতাংশ মাঠ তৈরি হয়েছে। অন্য উপজেলার চাষিরাও মাঠে নামতে শুরু করেছেন। চাষিরা আগাম মাঠে নামায় লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও এবার ছাড়িয়ে যাবে।

কক্সবাজার বিসিক লবণ উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠ কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, মৌসুম শুরুর আগেই লবণ উৎপাদন হওয়ায় সংশ্লিষ্টরা খুবই খুশি। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শতভাগ জমি চাষের আওতায় আসবে বলে আশা করা যায়।

তিনি আরও বলেন, দাম এখন কিছুটা পড়তি, তবে কিছুদিনের মধ্যে দাম বাড়বে। এতে চাষিরা লাভের মুখ দেখনে।

বিসিকের কক্সবাজার লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্প কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক জাফর ইকবাল ভুঁইয়া বলেন, যেসব জায়গায় লবণের চাষ করা হয়, সেখানে অন্য কোনো ফসল হয় না। তাই এবার ভিন্ন প্রযুক্তিতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে বিসিক।

গত বছর ৬৮ হাজার ৫০৫ একর জমিতে লবণ উৎপাদিত হয়েছিল ২৪ লাখ ৩৮ হাজার মেট্রিক টন, যা বাণিজ্যিক লবণ উৎপাদন শুরুর পরবর্তী ৬২ বছরের সর্বোচ্চ রেকর্ড বলে জানান তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে