বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১০ বৈশাখ ১৪৩২
টাঙ্গাইল আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস

'চ্যানেল ফি'র যাঁতাকলে গ্রাহক হয়রানি চরমে

দালালচক্র সক্রিয় চ্যানেল ফি বাধ্যতামূলক বিয়েরও 'সনদ' প্রয়োজন!
জোবায়েদ মলিস্নক বুলবুল, টাঙ্গাইল
  ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
'চ্যানেল ফি'র যাঁতাকলে গ্রাহক হয়রানি চরমে
'চ্যানেল ফি'র যাঁতাকলে গ্রাহক হয়রানি চরমে

আশাভগ্ন হৃদয়ে একটি ফাইল হাতে টাঙ্গাইল জেলা পরিষদের মাঠে বসে আছে এক যুবক। ছদ্দনাম আবুল হাসেম দুলাল। বয়স ২৭ বছর। কাছে যেতেই জানা গেল তিনি পাসপোর্ট করতে এসেছেন। বাড়ি টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলায়। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা জমা দিয়ে যথাযথভাবে অনলাইনে পাসপোর্টের আবেদন ফরম পূরণ করেছেন। এসেছেন আবেদন ফরম জমা দিতে।

তিনি জানালেন, 'বিয়ে করেনি' মর্মে চেয়ারম্যানের কাছ থেকে সার্টিফিকেট না আনায় তার ফাইল পাসপোর্ট অফিসের অফিস সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক জোবায়ের আহমেদ জমা না নিয়ে ফেরত দিয়েছেন। এক আনসার সদস্য তাকে একটি মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলেছেন। তিনি যোগাযোগ করায় এক দালালের কাছ থেকে জানতে পেরেছেন, এভাবে সরাসরি ফরম জমা নেবে না, ১৫০০ টাকা তাকে দিলে তিনি ফরম জমা নেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। তার কাছে নিজের যাতায়াতের খরচ ব্যতীত টাকা নেই। তাই বসে আছেন। কেন পাসপোর্ট দরকার জানতে চাইলে বললেন, তেমন লেখাপড়া করেননি, তাই বিদেশে যাবেন ভাগ্য পরিবর্তন করতে। এ অবস্থা শুধুমাত্র দুলালেরই নয়- টাঙ্গাইল আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে আবেদন ফরম জমা দিতে আসা প্রায় সবার।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টাঙ্গাইল অঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ে অবৈধ চ্যানেল ফি ও দালালদের দাপটে গ্রাহক হয়রানি চরমে পৌঁছেছে। গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের বাইরে কারও আবেদন ফরম জমা নেওয়া, ভেরিফিকেশন (তদন্ত), পাসপোর্ট ডেলিভারী ইত্যাদি কোনো কাজই হয় না। কার্যালয়ের অফিস সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক জোবায়ের আহমেদ ও মাস্টাররোলে কর্মরত পরিচ্ছন্নতাকর্মী মাসুম হরিজন পাসপোর্ট অফিসের সিন্ডিকেটের মূল হোতা। তাদের সঙ্গে কয়েকজন আনসার সদস্য এবং বহিরাগত ১৫-২০ জন দালাল জড়িত। প্রতি পাসপোর্টের বিপরীতে সরকারি ফি'র বাইরে ১১০০ টাকা উৎকোচ নেওয়া হয়। নিয়ম না থাকলেও প্রতিদিন দুপুর ১টার পর আবেদন ফরম জমা নেওয়া হয় না- কিন্তু দ্বিগুণ টাকা উৎকোচ দিলেই আবেদন ফরম জমা নেওয়া হয়। উৎকোচ নেওয়ার এই পদ্ধতির নাম চ্যানেল ফি। দালালরা চ্যানেল ফি'র নামে প্রতি পাসপোর্টে দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে আবেদন ফরম জমা নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এ ক্ষেত্রে ১১০০ টাকা অফিসে জমা দিয়ে বাকি টাকা তারা পকেটস্থ করেন। চ্যানেল ফি'র টাকা পাসপোর্ট অফিসের সবাই ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ে থাকেন। পাসপোর্ট করতে আসা গ্রামগঞ্জের গ্রাহকদের কাছ থেকে নির্ধারিত ফি'র দ্বিগুণ টাকাও নেওয়া হয়ে থাকে।

সরেজমিন পাসপোর্ট অফিসের ভেতর গিয়ে দেখা যায়, আবেদনের ফরম জমা দেওয়ার লম্বা লাইন। এ সময় সখীপুর উপজেলা থেকে আসা আসাদুজ্জামান (ছব্দনাম) জানান, তিনি প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অথচ যারা দালাল ধরে এসেছে, তারা অনেকেই কাজ শেষ করে চলে গেছে। আরও ভেতরে যেতেই দেখা যায় পাসপোর্ট অফিসের ডেলিভারী কক্ষের সামনে শ' শ' মানুষের ভিড়। কক্ষের দরজার সামনে রাশিদুল (ছব্দনাম) নামে এক যুবক পাসপোর্ট নিতে অসুস্থ শরীরে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি জানান, প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে অসুস্থ শরীরে দাঁড়িয়ে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তার সামনে অনেকেই পাসপোর্ট নিচ্ছে। কিন্তু তারটা হচ্ছে না। তিনি জানান, শুনেছিলেন সরকারি অফিসে অসুস্থদের জন্য আলাদা সেবা দেওয়া হয়। এখানে এসে সেবার পরিবর্তে ভোগান্তির শিকার হয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

স্থানীয়রা জানায়, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানের পর বেশিরভাগ অফিস দালালমুক্ত হলেও পাসপোর্ট অফিস দালালমুক্ত হয়নি। বরং অন্য অফিসের দালালরা পাসপোর্ট অফিসে কর্মসংস্থান করে নিয়েছে। দালালরা স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা বা ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে দালালি করছে। এতে বিভিন্ন উপজেলার দূর-দূরান্ত থেকে পাসপোর্ট করতে আসা লোকজন হয়রানির পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। পাসপোর্ট আবেদনকারীরা এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

তারা জানান, পাসপোর্ট অফিসের সিন্ডিকেটের থাবায় গ্রাহক ভোগান্তি ও দুর্নীতির অক্টোপাস প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। অতিরিক্ত টাকা ছাড়া পাসপোর্ট করা খুবই কষ্টকর। অফিসের প্রায় সব কর্মকর্তা ও পিয়ন উৎকোচ গ্রহণের সঙ্গে জড়িত। এটা এক প্রকার 'ওপেন সিক্রেট' হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাসপোর্ট করে দেওয়ার জন্য দালালরা ওতপেতে থাকে। অফিসে দালাল ছাড়া কোনো পাসপোর্টের আবেদন ফরম গ্রহণ হয় না। সাধারণ মানুষ চরম হয়রানির শিকার হচ্ছে।

স্থানীয় দালালদের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, টাঙ্গাইল আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে দুই ধরনের পাসপোর্ট ফি রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ফি সাত হাজার টাকা আর ভিআইপি ফি সাড়ে আট হাজার টাকা। কয়েকজন দালাল জানান, পাসপোর্ট অফিস সরকারি হলেও মূলত তারাই নিয়ন্ত্রণ করেন। অফিসের আশপাশে তাদের নিজেদের বা পরিচিতজনদের কম্পিউটারের দোকান আছে। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে বিকালে ফরম জমা দিতে গেলেও অফিস থেকে নানা ভুলত্রম্নটি দেখিয়ে ফেরত পাঠায়। আর চ্যানেল ফি হিসেবে ১২০০-১৫০০ টাকা নগদ দিলে ৪০০-৫০০ মানুষের সিরিয়াল থাকলেও মুহূর্তের মধ্যে পাসপোর্ট ফরম জমা দেওয়া যায়। পাসপোর্ট অফিসের পাশের একটি সরকারি দপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, ৫ আগস্টের পর সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে পাসপোর্ট অফিসে অভিযান চালানো হলেও এখনো দালাল নির্মূল হয়নি। মাঝেমধ্যেই তিনি দালালদের সঙ্গে অনেকের ঝগড়া হতে দেখেন। এতে তাদেরও ভোগান্তি হয়।

পাসপোর্ট অফিসে মাস্টাররোলে কর্মরত মাসুম হরিজন জানান, তিনি মূলত গ্রাহকদের পাসপোর্ট ডেলিভারী দিয়ে থাকেন। অফিস সহকারী জোবায়ের আহমেদের নির্দেশে অফিসের অন্য স্টাফ ও আনসার সদস্যরা ফরম জমা নেন। চ্যানেল ফি'র বিষয়ে তিনি জানান, এরকম ব্যবস্থা আগে ছিল- এখন নেই। তবে ভিআইপিদের পাসপোর্টের ক্ষেত্রে ফুট-ফরমায়েস করে দিলে তারা বখশিস দেন- এটাতে তিনি দোষের কিছু দেখেন না।

অফিস সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক জোবায়ের আহমেদ জানান, অফিসের উপ-পরিচালক বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যেভাবে অফিস চালাতে বলেন তিনি সেভাবেই চালান। চ্যানেল ফি'র বিষয়ে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

টাঙ্গাইল জেলা সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি বাদল মাহমুদ জানান, বাংলাদেশের দুর্নীতি অনেক গভীরে প্রোথিত। এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে দুর্নীতি নেই। এখনো অনেক জায়গার দুর্নীতি ভাঙা যায়নি। কোনো কোনো জায়গায় দুর্নীতিবাজরা প্রকাশ্যে আসতে ভয় পায়। কিন্তু গোপনে ঠিকই দুর্নীতি করছে। দেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের ভাবতে হবে কীভাবে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যায়।

টাঙ্গাইল আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালকের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক জেবুন্নাহার পারভীন জানান, প্রতিদিন ৪৫০-৫০০ জন পাসপোর্টের আবেদন নিয়ে আসেন। এ জন্য অফিসের নিচে অস্থায়ী ছাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যুবকের বিয়ের 'সনদে'র বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, এ ধরনের কোনো সনদের কথা তার জানা নেই।

তিনি জানান, দালালদের কারণে সেবা দিতে তারাও হিমশিম খাচ্ছেন। তার অফিসের কেউ দালালদের বিরুদ্ধে কথা বললে পরবর্তীতে দালালরা তাদের দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়। এরপরও তিনি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে