বাংলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে চলছে নবান্ন উৎসব

প্রকাশ | ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

স্বদেশ ডেস্ক
জয়পুরহাটের কালিয়ায় নবান্ন উৎসব ঘিরে অনুষ্ঠিত মাছের মেলা -যাযাদি
'নতুন ধান্যে হবে নবান্ন'- এর ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন এলাকায় সনাতনী পঞ্জিকা মতে বাংলা সনের অগ্রহায়ণের প্রথম দিন রোববার পালন করা হচ্ছে নবান্ন উৎসব। এ উৎসব পালনে নানা আয়োজন চলছে। কোথাও বসেছে জামাইদের নিয়ে মাছের মেলা, কোথাও বা চলছে পিঠা-পুলি ও পায়েসের আয়োজন। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে বিস্তারিত- জয়পুরহাট ও কালাই প্রতিনিধি জানান, জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার পাঁচশিরা বাজারে অগ্রহায়ণ মাসের দ্বিতীয় দিনে নতুন ধান ঘরে ওঠার আনন্দে মেয়ে-জামাই, বিয়াই-বিয়াইনসহ নিকট আত্মীয়দের নিয়ে নবান্ন উৎসবে মেতে ওঠেন কৃষকরা। পিঠা-পায়েসসহ নানা আয়োজনে স্বজনদের নিয়ে পালন করেন কৃষকের কাঙ্খিত নবান্ন উৎসব। জামাইদের উদ্যোগে বসে কালাই পৌর শহরের পাঁচশিরা বাজারে এক দিনের মাছের মেলা। এ দিনকে ঘিরে পৌরশহরের পাঁচশিরা বাজারে ভোর ৪টা থেকে দিনব্যাপি চলে ছোট-বড় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ কেনা-বেচার উৎসব। এ দিনটির অপেক্ষার প্রহর গোনেন উপজেলার লোকজন। ক্যালেন্ডার নয়, পঞ্জিকা অনুসারে অগ্রহায়ণ মাসের দ্বিতীয় দিনে এ জেলায় একমাত্র পাঁচশিরা বাজারেই বসে বৃহত্তম এ মাছের মেলা। রোববার ভোররাত থেকেই মেলা জুড়ে ছিল ক্রেতা-বিক্রেতা আর কৌতুহলী মানুষের ঢল। মেলায় নদী, দীঘি ও পুকুরের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা দেশীয় প্রজাতির টাটকা মাছে ছিল ভরপুর। মাঠ থেকে নতুন ফসল কৃষকদের ঘরে উঠলেই এই দিনে আয়োজন করেন নবান্ন উৎসবের। অনুষ্ঠানে জামায়-মেয়ে, বিয়াই-বিয়াইনসহ নিকট আত্মীয়-স্বজনরা যোগ দেন। প্রতিযোগিতা করে মেলা থেকে জামাইরা মাছ কিনে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যান। প্রতিটি দোকানে সাজানো ছিল দেশীয় জাতের রুই, মৃগেল, কাতলা, চিতল, সিলভার কার্প, পাঙ্গাস, ব্রিগেটসহ নানা ধরনের মাছ। এবার মেলায় সর্বোচ্চ ৩০ কেজি ওজনের একটি কাতলা মাছ বিক্রি হয়েছে ৩২ হাজার টাকায় এবং ১৯ কেজি ওজনের একটি সিলভারকাপ মাছ বিক্রি হয়েছে ১৪ হাজার টাকায়। মেলার আয়োজন করেন স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ীরা। একসপ্তাহ আগে থেকে মেলার জন্য প্রস্তুতি নেন ব্যবসায়ীরা। এ উপলক্ষে দুই দিনব্যাপী এলাকায় মাইকে প্রচারও করেন তারা। মাছ ব্যবসায়ী ও স্থানীয়রা জানান, পাড়া-মহলায় জেগে ওঠে উৎসবের আমেজ। পিঠা-পুলি, পায়েস, গুড় ও চিনির ক্ষীর সঙ্গে খই ও মুড়ি খাওয়ার ধুম পড়ে। এ উপলক্ষে মাছের মেলা বসেছে কালাই পৌর শহরের পাঁচশিরা বাজারে। ব্যবসায়ীরা কয়েকদিন আগে থেকে আড়ৎ ঘরে নানা জাতের বড় বড় মাছ সংগ্রহ করেন। এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ উচ্চমূল্যে মাছ কেনেন। ধর্ম-বর্ণ নিবিশেষে মেলায় ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মত। মাছ ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফ জানান, মেলায় পুকুর, দীঘি ও নদী থেকে নানা জাতের বড় বড় মাছ সংগ্রহ করা হয়েছে। কাতলা, রুই, মৃগেল ৪শ' থেকে ১২শ' টাকা কেজি এবং চিতল মাছ ১৩শ' থেকে ২ হাজার টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি ৪শ' টাকা থেকে ৫শ' টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। মাছ কিনতে আসা বগুড়ার মোকামতলা থেকে আগত আঁওড়া মহলস্নার জামাই বেলাল হোসেন জানান, নবান্ন উৎসবে শশুর প্রতিবছরই দাওয়াত করেন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে এসেছেন। প্রথা অনুযায়ী এ মেলা জামাই-মেয়ে উপলক্ষে আয়োজন করা হয়, সে কারনে মাছ একটা কিনতেই হয়। এবার ১২ কেজি ওজনের একটি কাতল মাছ কিনেছেন। অন্য বছরের চাইতে এবার মাছের দাম একটু বেশি। হাতিয়র গ্রামের কৃষক রানা মিয়া জানান, এই দিনের অপেক্ষায় মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনি ও আত্মীয়-স্বজনরা চেয়ে থাকে। কষ্ট হলেও তাদের জন্য আয়োজন করতে হয়। ইজারাদার আব্দুল মান্নান জানান, প্রতিবছর এই দিনে নবান্ন উৎসব উপলক্ষে অটোভাবে মাছের মেলা বসে। মাছ ব্যবসায়ীরা মেলার আগে এলাকায় মাইকে প্রচার করেন। মাছ আমদানি যেমন বেশি হয়, তেমনি বিক্রিও হয় বেশি। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তৌহিদা মোহতামিম জানান, মেলায় ছোট বড় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ উঠেছে। মেলায় ১ থেকে সোয়া কোটি টাকার মাছ ক্রয়-বিক্রয় হবে। মৎস্য বিভাগ চাষিদের সবসময় মাছ চাষে পরামর্শ দিয়ে আসছে। আগামীতে এ মেলার পরিধি আরও বাড়বে। গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, নানা আয়োজনে রোববার বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে (ব্রি) নবান্ন উৎসব উদযাপিত হয়েছে। এ উপলক্ষে এদিন সকালে ব্রির প্রশাসনিক ভবনের সামনে বেলুন উড়িয়ে উৎসব উদ্বোধন করেন ব্রি'র মহাপরিচালক ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান। পরে এক সংক্ষিপ্ত আলোচনাসভা শেষে একটি বর্ণাঢ্যর্ যালি বের হয়ে ব্রির সদর দপ্তরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।র্ যালি শেষে অতিথিরা মাঠে ধান কাটার উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। ব্রি'র পরিচালক (প্রশাসন ও সাধারণ পরিচর্যা) ড. আব্দুল লতিফের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন ব্রি'র মহাপরিচালক ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন ব্রি নবান্ন উৎসব আয়োজন কমিটির সদস্য সচিব এবং শস্যমান ও পুষ্টি বিভাগের প্রধান ড. আনোয়ারুল হক। পরে নবান্ন উৎসব উপলক্ষে পিঠা ও পায়েস বিতরণ করা হয়। দুপচাঁচিয়া (বগুড়া) প্রতিনিধি জানান, 'নতুন ধান্যে হবে নবান্ন'- এর ধারাবাহিকতায় বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সনাতনী পঞ্জিকা মতে বাংলা সনের অগ্রহায়ণের প্রথম দিন রোববার সনাতন ধর্মালম্বীরা (বাঙালি) নবান্ন উৎসব পালন করেছেন। উপজেলার ফেঁপিড়া, সাবলা, গয়াবান্ধা, খানপুর, সরঞ্জাবাড়ী, কইল, আমষট্ট, মাজিন্দা, গোবিন্দপুর, ও উপজেলা সদরসহ এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এ উৎসব পালনে নানা আয়োজন করে থাকেন। এদিন প্রতিটি বাড়ির আঙ্গিনায় আতপ চাল গুলিয়ে আল্পনা আঁকেন, উঠান ও ধানের গোলায় গোবর গুলিয়ে প্রলেপ দেন। সকালে ছোট ছোট ছেলের দল স্নান (গোসল) করে নতুন ধুতি পড়ে বয়স্ক লোকদের সঙ্গে আবাদি জমিতে যায়। সেখান থেকে তিন গোছা ধান কেটে তাতে সিঁদুর, কাজলের ফোটা, কলাপাতা দিয়ে ঢেকে মাথায় করে বাড়ির আঙ্গিনায় নিয়ে আসে। এ সময় গৃহবধূরা শঙ্খ বাজিয়ে উলুধ্বনি দেয়। এ ধরনের অনুষ্ঠানকে এ অঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়ে লোকজন আগকাটা (প্রথম ধান কাটা) বলে থাকেন। তারপর কাটা ধানগাছের গুচ্ছ ঘরের ছাদের তীরে আটকিয়ে রাখা হয়। এটি হিন্দু ধর্মালম্বীদের একটি ঐতিহ্য। এ নবান্নকে ঘিরে সনাতন ধর্মালম্বীরা নতুন অন্ন পিতৃ পুরুষ ও দেবতাকে উৎসর্গ করে এবং আত্মীয়স্বজনকে পরিবেশন করার পর গৃহকর্তা ও পরিবারের সদস্যরা তা গ্রহণ করে। এছাড়াও অন্ন গ্রহণের পূর্বে মিষ্টি আলু, কেশর, আখ ও নতুন ধান ঢেঁকিতে ভেঙে সেই চাল মিশ্রিত করে এক প্রকার খাদ্য তৈরি করে তা অন্ন গ্রহণের পূর্বে পরিবারের শিশুসহ বয়োবৃদ্ধরা একত্রে বসে খেয়ে থাকেন। মূলত এইটিই সনাতন ধর্মালম্বীদের লোকজ ঐতিহ্য। তবে একসময় নবান্নের পরের দিন দলবেঁধে ছেলেমেয়েরা একে অপরের বাড়িতে বসে খাওয়া দাওয়া করত। এখন আর সেই চিত্র চোখে পড়ে না। উপজেলার তালোড়া বাজারের বাসিন্দা প্রবীণ ব্যক্তি প্রফুলস্ন চন্দ্র প্রামাণিক বলেন, নবান্ন উৎসবটি গ্রাম বাঙলার অতীত ঐতিহ্যের প্রতীক। লৌকিকতা এ অনুষ্ঠানটিকে শুধু হিন্দু ধর্মালম্বীরাই নন, অন্য ধর্মের লোকেরাও আনন্দের স্বাদ খুঁজে পান। এদিকে এ নবান্ন উৎসব উপলক্ষে দুপচাঁচিয়া উপজেলা সদরসহ বিভিন্ন হাটবাজারে বড় বড় মাছের মেলা বসে। সাধ্যমত লোকজন রকমারী সবজিসহ বড় বড় মাছ কিনে হরেক রকম সুস্বাদু রান্না, নতুন ধানের চালের পায়েস, পিঠা, পুলি তৈরি করে মেয়ে-জামাইসহ আত্মীয়স্বজনদের আপ্যায়ন করে থাকেন।