বিনোদনেও পিছিয়ে পাহাড়ের শিশুরা

প্রকাশ | ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

সাকিব আলম মামুন, লংগদু (রাঙামাটি)
রাঙামাটির লংগদুতে খেলাধুলায় ব্যস্ত পাহাড়ী শিশুরা -যাযাদি
ঘন সবুজ পাহাড়, নির্জন ও দুর্গম পাহাড়িপথ, আঁকাবাঁকা স্বচ্ছ জলের ঝিরিপথ, বড় বড় পাথর, শত বছরের প্রাচীন বৃক্ষ পেরোলেই চোখের সামনে ধরা দেবে চমৎকার এক গ্রাম 'গদাবইন্যা ছড়া'। পাহাড়ি এই ছোট্ট গ্রামের মিশুক স্বভাবের মানুষগুলো অধিকাংশই চাকমা সম্প্রদায়ের। তবে কেউ কেউ রয়েছেন অন্য গোত্রেরও। গ্রামের সবাই খুবই সাদাসিধে কিন্তু প্রাকৃতিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত। এর ছাপ পাওয়া যায় তাদের ঘরবাড়ি, পোশাক, চলাফেরা, চলন-বলনে এবং খাওয়া-দাওয়াসহ দৈনন্দিনের যাপিত জীবনে। তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানের বিভিন্ন উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস এ পাহাড়ের কোলজুড়ে। এখানে বসবাসকারী লোকদের প্রতি মুহূর্তে করতে হচ্ছে জীবন সংগ্রাম। এ সংগ্রামে পিছিয়ে পড়ছে শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান থেকে শুরু করে বিনোদন ক্ষেত্রেও। বিচিত্রময় এ জীবনে পাহাড়ের কোলে জুমচাষ ও মাছ ধরেই জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে তারা। এই দুর্গম গ্রামে মানুষের মাঝে সুখ-শান্তি সবই আছে, কিন্তু নেই শিশুদের ভালোভাবে গড়ে ওঠার জন্য সাধারণ চাহিদাগুলো। তন্মধ্যে অন্যতম অপূরণীয় চাহিদা হলো বিনোদন খাত। যে বিষয়টি সমতলের তুলনায় পাহাড়ের শিশুরা পুরোপুরি বঞ্চিত। পাহাড়ি গ্রামগুলোতে শিশুদের বিনোদনের খুবই অভাব। প্রাথমিক স্কুলে নাই খেলার কোনো ব্যবস্থা। স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে বাড়ির আশপাশেও নেই তেমন কোনো খোলা মাঠ। বলতে গেলে খেলা বা বিনোদনের তেমন কোনো ব্যবস্থাই নেই পাহাড়ি গ্রামের শিশুদের। তাদের বিনোদন বলতে গ্রামের চায়ের দোকানের কয়েকটি টেলিভিশনই ভরসা। তবে অধিকাংশ গ্রামেই নেই টেলিভিশন ও বিদু্যৎ। ব্যতিক্রম আছে কোথাও কোথাও। যেমন- শিলাছড়া, লেমুছড়ি। পার্বত্য জেলা রাঙামাটির লংগদু উপজেলার আটারকছড়া ইউনিয়নের এ গ্রামের সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। বর্ষায় মাইনী নদীপথেই গ্রামের মানুষের যাতায়াত। অন্যথায় দুর্গম সড়কপথে। এসব গ্রামের লোকসংখ্যা কমবেশি তিন শতাধিক। বসতবাড়ি রয়েছে সবমিলিয়ে ৫৭টি। চায়ের দোকানসহ কয়েকজনের বাড়িতে রয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি টেলিভিশন। দুই-চারটি দোকান ছাড়া স্যাটেলাইট সংযোগও নেই। শিশু রুপেন চাকমা নামের এক কিশোর জানায়, তার এলাকায় খেলাধুলার কোনো ব্যবস্থা নেই। টেলিভিশন দেখেই আনন্দ পায়। টিভি দেখার জন্য এখানে ওখানে দৌঁড়ায়। তার পছন্দ কার্টুন। যদিও সে নিজের মতো করে কিছুই দেখতে পায় না। প্রাথমিকের ছাত্র ছদক, মনিষ ও টিটন চাকমারও কার্টুন পছন্দ। তবে দেখা হয় না বললেই চলে। কখনো নদীর তীর ঘোরাঘুরি করে, আবার কখনো খোলা জায়গায় বল নিয়ে দৌঁড়াদৌড়ি করেই সময় কাটায়। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, পাহাড়ি গ্রামের শিশুদের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি আন্তরিকতা, পরিকল্পনা, সমন্বিত উদ্যোগ এবং ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে পারলে ছবির মতো পাহাড়ি গদাবইন্যাছড়া ও লেমুছড়ির শিশুরা রঙিন প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াতে পারবে। স্থানীয় ও গবেষকরা বলছেন, পাহাড়ের কোলে স্থাপিত স্কুলগুলোতে বা আলাদা উদ্যোগ নিয়ে শিশুদের জন্য বিনোদন কেন্দ্র অথবা খেলাধুলার মনোনিবেশিত পরিবেশ যদি গড়ে তোলা যায়, তবে এখান থেকেও তৈরি হবে ঋতুপর্ণা, রুপনা ও মনিকার মতো জাতীয় পর্যায়ের নামকরা খেলোয়াড়। তাহলেই বিশ্বব্যাপী দেখতে পাবে চিরসবুজ বাংলাদেশ ও পাহাড়ের প্রাকৃতিক রং। সবুজ সুন্দর এ পাহাড় থেকে ছোট্ট মিষ্টি বাচ্চাদের চোখে ধরা দেবে নতুন দিনের স্বপ্নের ঝিলিক। তবে শিশুদের এ স্বপ্ন দেখা প্রতিনিয়তই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে যথাযথ উদ্যোগ না থাকার কারণে। তাই এখন সময়ের দাবি পাহাড়ে শিক্ষার পাশাপাশি শিশুদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা করা।