বাঙালির ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে মৃৎশিল্প। একটা সময় এ শিল্পের ওপর নির্ভর করেই আবহমান গ্রামবাংলায় গড়ে উঠত একেকটি কুমোড় পাড়া। নরম কাঁদা মাটিকে হাতের স্পর্শে মনোরম, দৃষ্টিনন্দন এবং ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তোলা কুমোড় পাড়ার প্রতিটি নর-নারীর হাতেই রয়েছে যাদুর ছোঁয়া। যে যাদুতে একেকটি কাঁদামাটির খন্ড দৃষ্টিনন্দন নানা আসবাবপত্রসহ স্থান বাহারি বাসনের স্থান করে নিত প্রায় প্রতিটি বাঙালির ঘরে। কিন্তু প্রযুক্তির উন্নয়ন আর মানুষের জীবন যাপনে চাহিদার পরিবর্তনের সঙ্গে এখন এসব ঐতিহ্য বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মৃৎশিল্পের বর্তমান চাহিদা অতি নগণ্য। বর্তমানে মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত পরিবারের সদস্যদের দুই বেলা ডাল-ভাত জোগাড় করাই যেন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। তাই অনেকেই গ্রামবাংলার এই ঐতিহ্য ছেড়ে এখন পেশা বদলানোর চেষ্টায় প্রতিনিয়ত অতিবাহিত করছেন। কেননা 'ঐতিহ্য বেঁচে এখন আর সংসার চালানো যায় না'- বলেই তারা ধরে নিয়েছেন।
'ঈশ্বরদী উপজেলা শহরের বিভিন্ন এলাকায় মাটির তৈরি বিভিন্ন বাসনের এখনো ভালো চাহিদা রয়েছে। এ অঞ্চলের মানুষের চাহিদা মেটানোর জন্যই আমরা বছরের ৫ মাস নওগাঁ থেকে ঈশ্বরদীতে মেইল ট্রেনে মাটির জিনিসপত্র এনে এ অঞ্চলে বিক্রি করি। তবে মাটি সংগ্রহ থেকে শুরু করে রোদে শুকিয়ে আগুনে পোড়াতে যত শ্রমিকের প্রয়োজন হয় বিক্রি করে সেই খরচ তুলতেই হিমশিম খাচ্ছি আমরা।'
মৃৎশিল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা এবং কেবল এ শিল্পের ওপরই নির্ভর পরিবারের কর্তা মোবারক হোসেন (৫৭) মৃৎশিল্পের ভবিষ্যৎ শঙ্কা নিয়ে এভাবেই তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। মৃৎশিল্পের কারিগর এবং বিক্রেতা মোবারক হোসেন নওগাঁর আত্রাই থানাধীন মির্জাপুর গ্রামের বাসিন্দা। ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন স্টেশন পস্ন্যাটফর্মে দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে সন্ধ্যায় পরের দিনের প্রস্তুতির সময় আলাপকালে যায়যায়দিনকে এভাবেই মৃৎশিল্পের অন্ধকার ভবিষ্যৎ নিয়ে তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন মোবারক হোসেন।
তিনি বলেন, মাটির টেকসই তৈজসপত্র তৈরি করতে এক ধরনের এঁটেল (লাল রঙের) মাটির প্রয়োজন হয়, যা সবখানে পাওয়া যায় না বলে অন্যত্র থেকে উচ্চ মূল্যে কিনতে হয়। যে মাটির প্রতি কেজির মূল্য ১০০ টাকা। পোড়ানো কাঁচা কাঠের দাম ২০০ টাকা মণ। স'মিলের গুঁড়াও (জ্বালানি) এখন দাম বেড়ে হয়েছে ৩০০ টাকা বস্তা। সব মিলিয়ে তৈরির উপকরণের খরচাদির সঙ্গে বিক্রির ব্যবধানটা কখনই আশানুরূপ হয় না। তবুও পূর্ব পুরুষ আর গ্রামবাংলার ঐতিহ্য বলে এগুলোকে এখনো পুরোপুরি ছাড়তে পারেননি। তবে এগুলোকে হয়তো বা আর বেশিদিন ধরে রাখতেও পারবেন না বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন তিনি।
বিক্রির বাহন সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানান, বাঁশের তৈরি দুটি বড় মাপের ঝাকার মধ্যে বড় থেকে ছোট সমন্বয়ে বিশেষ কায়দায় সাজানো হয় মাটির তৈরি পাত্রগুলোকে। তারপর ঝাঁকাগুলোকে একটি বাঁশের বাঁকের দুই মাথায় দুটোকে ঝুলিয়ে সারাদিন গ্রামে ঘুরে বিক্রি করেন। ফুরিয়ে গেলে আবার এলাকা থেকে এনে সেগুলোকে সংরক্ষণ করা হয় ঈশ্বরদী রেলওয়ে স্টেশন পস্ন্যাটফর্মের একটি শেডের নিচে। সেখান থেকেই দিন শুরু হয়। আবার দিন শেষেও সেখানেই ফিরে খোলা মাঠেই রাত্রি যাপন করেন। দিনের খাবার খান গ্রামের বিভিন্ন টং দোকানে। ভাতের সঙ্গে দেখা হয় দিনে একবার। এত কষ্ট করেও যদি পরিবারের মুখে ভালোমতো দুই মুঠো ভাত তুলে দিতে পারতেন তাহলে সব কষ্ট ভুলে থাকতে পারতেন বলে জানান তিনি। তার মতে, 'কী আর করা, অন্য কাজ তো শিখিনি। আবার গ্রামবাংলার ঐতিহ্য বেঁচে এখন আর সংসারও চলে না।'