নানা কারণেই টাঙ্গাইলের প্রসিদ্ধি রয়েছে। তার মধ্যে পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকা যেখানে সেগুন, গজারিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ছিল। সেখানে ছিল মানুষের রোগ নিরাময়ের জন্য ওষুধি গাছ। কালের বিবর্তনে কিছু অসাধু ব্যক্তির থাবায় আজ সেগুলো হুমকিতে মুখে। একসময় শাল-গজারিসহ নানা প্রজাতির দেশীয় গাছে আচ্ছাদিত ছিল টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার বনাঞ্চল। স্থানীয়দের অভিযোগ, সামাজিক বনায়নের নামে কৃত্রিম বনায়ন সৃষ্টি করে ধ্বংস করা হয়েছে সেই প্রাকৃতিক বন। সেই সঙ্গে বনে বাস করা বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণীও বিলুপ্তপ্রায়। পরিবেশবিদদের দাবি, প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে কৃত্রিম বনায়ন করা হলে পরিবেশ তার ভারসাম্য হারাবে। ঘাটাইলের বনাঞ্চল শাল-গজারির বন হিসেবে খ্যাত মধুপুর গড় এলাকার একটি অংশ। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এ বনে শাল-গজারির পাশাপাশি ছিল আমলকী, হরীতকী, বহেড়া, অর্জুন, তিতিজাম, আজয়, আনাইগোটা, খেজুর, বট, শিমুল, ছাগলনাদি, চুকাইগোটা, জয়নাগোটা, পিতরাজ, শাল, গর্জন, সোনালু লটকন, নাগেশ্বর, বন আমড়া, খাড়াজোড়া, গামার, নেওড়, কানাইডাঙ্গা, জলপাই, কদমসহ নানা প্রজাতির গাছ। বনে দেখা মিলত মেছোবাঘ, বাগডাশা, বুনো শূকর, হাতি, বানর, সজারুসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। এছাড়াও প্রায় অর্ধশত প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখর থাকতো বন। এখন পুরোবন ঘুরেও দেখা মিলবে না প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা কোনো প্রাচীন গাছ। বানর, হাতি দূরের কথা, দেখা মিলবে না বাগডাশের। শেয়ালের হাঁকও মেলে কালেভদ্রে। স্থানীয়দের দাবি, প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে সামাজিক বনায়নের নামে কৃত্রিম বনায়ন পশু-পাখির অভয়ারণ্য ধ্বংসের জন্য দায়ী। বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, ঘাটাইল উপজেলায় বনভূমির পরিমাণ ২৫ হাজার ৭১১ একর। তিন দশক আগেও এই বনাঞ্চলটি ছিল শাল-গজারিসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাকৃতিক গাছপালায় ঘেরা। ১৯৮৪ সালের দিকে এ অঞ্চলে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি শুরু হয়, যা এখনো চলছে। সামাজিক বনায়ন হওয়ায় পর থেকেই শুরু হয় প্রাকৃতিক বন ধ্বংসের কার্যক্রম। দেশীয় বৃক্ষের স্থানে লাগানো হয় আকাশমনি, সেগুন, মেহগনি, ইউক্যালিপটাসসহ নানা জাতের বিদেশি গাছ। সেই থেকেই কমতে শুরু করে শাল-গজারিসহ প্রাকৃতিক বনের গাছ। বাসাবাইদ গ্রামের কৃষক জামাল বলেন, কৃত্রিম বনের গাছের নিচে লতাপাতা জাতীয় কোনো গাছ জন্মায় না। ফল না থাকায় গাছে পশু-পাখিও বসতে চায় না। আকাশমনি ও ইউক্যালিপটাস গাছের নিচে ঘাস পর্যন্ত জন্মায় না। গারোবাজার এলাকার মোতালেব হোসেন বলেন, তিন যুগ আগেও বন্যপ্রাণীর ছোটাছুটি আর পাখির কলকাকলিতে মুখর ছিল এ বনাঞ্চল। সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম শুরুর হওয়ার পর থেকেই বিলুপ্ত হতে থাকে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও প্রাণী। তাদের বাসস্থান নিরাপদ না হওয়ায় খাদ্য সংকট দেখা দেয় এবং বনের জমি দখল করে বসতি স্থাপন করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। চাম্বলতলা গ্রামের কৃষক মানিক মিয়া জানান, এখন বনে দেশীয় প্রজাতির গাছ খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ফসলি জমির ক্ষতিকর পোকা খেয়ে উপকার করত। বিদেশি গাছের কারণে পাখি কমে যাওয়ায় জমিতে তেমন পাখি বসে না। তাই পোকা দমনে ক্ষতিকর কীটনাশকের ওপর নির্ভর করে কৃষকরা। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) বিভাগীয় সমন্বয়কারী গৌতম চন্দ্র চন্দ বলেন, এভাবে চলতে থাকলে একদিন শাল-গজারিসহ দেশীয় প্রজাতির গাছ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই প্রাকৃতিকভাবে গজানো গাছ সংরক্ষণে পরিকল্পনা করা উচিত। বন বিভাগের ধলাপাড়া রেঞ্জের কর্মকর্তা ওয়াদুদুর রহমান বলেন, 'সামাজিক বনায়নের কারণে প্রাকৃতিক বনের কোনো ক্ষতি হয় না। বন বিভাগের পতিত জমিতেই সামাজিক বনায়ন করা হয়। এতে শাল বনেরও ক্ষতি হয় না।'