মাঠজুড়ে কৃষকের সোনালি স্বপ্নের ছড়াছড়ি
আমন ধান কাটার উৎসব শুরু বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা দেশে খাদ্য ঘাটতি পূরণে সহায়ক বলে আশা
প্রকাশ | ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
স্বদেশ ডেস্ক
পাকা আমন ধানের সোনালি রঙে সেজেছে কৃষকের ফসলি মাঠ। যতদূর চোখ যায় শুধু পাকা ধানের সোনালি রূপ দেখা যায়। গ্রামগঞ্জে চলছে এখন ধান কাটার উৎসব। প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে বিস্তারিত ডেস্ক রিপোর্ট-
তানোর (রাজশাহী) থেকে আমাদের প্রতিনিধি আসাদুজ্জামান মিঠু জানিয়েছেন, রাজশাহীসহ বরেন্দ্রের মাঠগুলোতে যতদূর চোখ যায়, চারদিকে সোনালী ফসলের সমারোহ। বরেন্দ্র অঞ্চল যেন সোনালী রঙে সেজেছে। সবুজপাতার ফাঁকে ফাঁকে দুলছে কৃষকের সোনালী স্বপ্ন। নতুন ধানের ঘ্রাণে ভরে উঠছে কৃষকের মনপ্রাণ। সেই সঙ্গে রঙিন হয়ে উঠছে প্রান্তিক কৃষকের স্বপ্ন। মাঠজুড়ে এখন সোনালী স্বপ্নের ছড়াছড়ি।
চলতি বছর বর্ষার আগেই বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। অগ্রিম বৃষ্টি পেয়ে আমন চাষে মাঠে নেমে পড়েছিলেন কৃষকরা। তাই এবার একটু আগাম ধান ঘরে উঠবে কৃষকের। চলতি কার্তিক মাসের মাঝামাঝি থেকে বরেন্দ্র অঞ্চলের অল্প পরিসরে সোনার ধান কাটা শুরু করছেন। অগ্রহায়ণ মাস পড়লেই পুরোদমে আমন কাটা-মাড়াই শুরু করবেন বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকরা।
এর আগে আমন রোপণের শুরু থেকেই নানা রোগবালাই ও ইঁদুরের অত্যাচারে কৃষকদের কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে। অবশেষে সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠেছেন তারা। এখন ফলন ভালো হবে- এমন স্বপ্ন নিয়ে নতুন করে আশায় বুক বেঁধেছেন এই অঞ্চলের চাষিরা।
মাঠপর্যায়ের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা জানান, চলতি বছর আবহাওয়া অনুকূল থাকায় অন্যসব বছরের চেয়ে চলতি বছর আমন ধান ভালো হয়েছে। এই অঞ্চলে এক শতক জমিও ফাঁকা নেই। আমনের শুরু থেকে ঘন ঘন বৃষ্টিপাত হওয়ায় এবার প্রকৃতিগতভাবে চাষিদের সেচের সব চাহিদা মিটেছে। প্রচুর পরিমাণে ধান চাষ হয়েছে। রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলে সর্বই এখন আমনে পাক ধরে সোনালী রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে। আর মাত্র ১৩ দির পরই অগ্রায়ণ মাস পড়বে। তখন পুরোদমে আমন কাটা-মাড়ায়ের ধুম পড়ে যাবে। এতে দেশে খাদ্য ঘাটতি পূরণে সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বরেন্দ্রের কৃষকরা জানান, পুরো মাঠ এখন সোনালী রঙে সেজেছে। মাঠে গেলে বাতাসের দোলে সোনালী ধানের সুগন্ধীতে মনপ্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে। অন্য যে কোনো বছরের চেয়ে চলতি বছর ধানের মাথা ভালো আছে। তাই বাম্পার ফলন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বর্তমানে বাজারে ভালো দামও আছে।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে রাজশাহী জেলায় আমনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭০ হাজার ২২৪ হেক্টর জমিতে। চাষাবাদ হয়েছে ৭৩ হাজার ৫২৩ হেক্টর জমিতে। এ ছাড়াও রাজশাহী অঞ্চলের রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় আমন চাষাবাদ হয়েছে আরও চার লাখ ১০ হাজার হেক্টরের ওপর।
বরেন্দ্র ভূমি রাজশাহী অঞ্চলের চার জেলায় চার লাখ সাত হাজার ৩৫৯ হেক্টর জমি থেকে ১৩ লাখ ১৮ হাজার ৫৯৮ টন আমন ফলনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
কৃষি বিভাগ সূত্রে আরও জানা গেছে, দেশের মধ্যে সর্বাধিক এক লাখ ৯৫ হাজার ৭৮ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে উত্তরের নওগাঁ জেলায়। দেশের শস্যভান্ডার-খ্যাত লালমাটির বরেন্দ্র ভূমির নওগাঁ জেলাতেই এবার সর্বোচ্চ ছয় লাখ ৫৬৯ টন আমন ধান পাওয়া আশা কৃষি বিভাগের।
এদিকে রাজশাহীর বরেন্দ্র ভূমি তানোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরা ঝিলিম নাচোল, নওগাঁর নিযামতপুর এলাকার গত কয়েকদিনে ঘুরে দেখা গেছে, সবুজপাতার ফাঁকে ফাঁকে সোনালী শিষ উঁকি দিচ্ছে। কোনো কোনো মাঠ পুরোটাই সোনালী রঙ ধরেছে।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চানন্দালায় গ্রামের আদর্শ কৃষক মানিক জানান, চলতি মৌসুমে ২০ বিঘা জমিতে লাল স্বর্ণা জাতের ধান চাষাবাদ করেছেন। বর্তমানে তার ক্ষেতের ধান পাক ধরেছে। শনিবার হতে ধান কাটা শুরু হয়েছে।
তানোর উপজেলার পাঁচন্দর গ্রামের কৃষক মনসুর রহমান জানান, চলতি মৌসুমে তিন বিঘায় আমন চাষাবাদ করেছেন। আমনের মাঝামাঝি সময় পোকা ও ইঁদুরের অত্যাচার ছিল। তবুও সমস্যা নেই, কারণ অন্যসব বছরের চেয়ে এবার আমন ধানের শিষ ভালো আছে।
তানোর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুলস্নাহ আহম্মেদ জানান, আমনের শুরু থেকেই চলতি বছর ঘন ঘন বৃষ্টি হওয়ায় বরেন্দ্র ভূমির উঁচু-নিচু এক শতকও জমি ফাঁকা নেই বরেন্দ্র অঞ্চলে। আমন চাষাবাদে কৃষকদের সব ধরনের সহযোগিতা করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এবার বরেন্দ্রের মাঠে পানিসাশ্রয়ী ও উচ্চ ফলনশীল অনেক জাতের ধান চাষ হয়েছে। এখন ধান পাকতে শুরু করেছে। কিছু কৃষক অল্প পরিসরে ধান কাটা শুরুও করেছেন। অন্য যে কোনো বছরের চেয়ে এবার ফলন বেশি।
সালথা (ফরিদপুর) থেকে আবু নাসের হুসাইন জানান, কার্তিক ও অগ্রহায়ণ নিয়ে হেমন্ত ঋতু। কার্তিকের আধাআধিতে ফরিদপুরের সালথায় আমন ধান কাটা নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন কৃষকরা। গ্রামগঞ্জে চলছে এখন ধান কাটার উৎসব। নতুন ধান ঘরে উঠাতে ব্যস্ত রয়েছে কৃষকরা। পাড়ায় পাড়ায় শুরু হয়েছে নবান্ন উৎসব। মূলত নতুন ধান কাটা আর সেই সঙ্গে প্রথম ধানের অন্ন খাওয়াকে কেন্দ্র করে পালিত হয় এই উৎসব। নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি করা হয় পিঠা, পায়েস, ক্ষীর, মুড়িসহ হরেক রকমের খাবার।
জানা যায়, উপজেলাজুড়ে ক্ষেত থেকে প্রায় প্রতিদিন ধান কাটা হচ্ছে। কয়েকদিনের মধ্যে সেগুলো ঘরে তোলার পর তাদের উৎসব শুরু হবে। তাই আনন্দে ভাসছে তারা। কৃষকরা ধান কেটে বাড়ি আনার পর কৃষাণিরা সেটা পরিষ্কার করে রোদে শুকিয়ে ঘরে তোলায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। এই ধান দিয়ে নবান্নের পিঠা তৈরির জন্য ঘরে ঘরে চালের গুঁড়া তৈরি হবে। মেয়ে জামাই, আত্মীয়স্বজন আর পাড়া প্রতিবেশীকে খাওয়াতে নানা ধরনের পিঠা, পায়েস তৈরি করা হবে। এরপর ঘরে ঘরে শুরু হবে নবান্ন উৎসব।
উপজেলার কৃষকরা জানান, এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ক্ষেতে ধান খুব ভালো হয়েছে। বপনকৃত আমন ধান আগেই কাটা শুরু হয়। এখন রোপণকৃত ধান কাটা পুরোদমে শুরু হয়েছে। ধানের ফলন খুব ভালো হচ্ছে। প্রতিটি এলাকায় চলছে উৎসবের আমেজ।
উপজেলা অতিরিক্ত কৃষি অফিসার সুদীপ বিশ্বাস বলেন, এ বছর উপজেলায় ১২ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ হয়েছে। ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৫৫ হাজার মে. টন। বর্তমানে চারদিকে চলছে ধান কাটা ও ঘরে তোলার উৎসব। ধানের ফলন দেখে কৃষকের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে।
পার্বতীপুর (দিনাজপুর) থেকে এম এ আলম বাবলু জানান, কাকডাকা ভোর আর গোধূলি লগ্নের ঘন কুয়াশা জানান দিচ্ছে শীতের আগমন বার্তা। এর মাঝে বেড়ে ওঠা রোপা-আমনের শিষ মৃদ বাতাসে দুলছে। সেই সঙ্গে দুলছে কৃষকের মন। এগুলো দেখে স্বপ্নের জাল বুনছেন কৃষক। এক বুক আশা নিয়ে ভাবছেন বাম্পার ফলনের কথা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় যথাসময় রোপণকৃত রোপা আমনের গাছগুলো এখন সবুজের সমারোহ ছড়াচ্ছে। সবুজের সমারোহ দেখে বাম্পার ফলনের আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রয়েছেন পার্বতীপুর উপজেলার কৃষক। দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলায় ইতোমধ্যে আগাম জাতের ধান কাটা শেষ হয়েছে।
উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি রোপা আমন মৌসুমে পার্বতীপুরে রোপা আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৮ হাজার ৮৮২ হেক্টর জমিতে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় কৃষকরা যথাসময় চারা রোপণ করতে শুরু করেছেন এবং লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে রোপা আমনের আবাদ করা হয়েছে। আবাদও হয়েছে বেশ ভালো। সব মিলিয়ে এবার বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে।
পার্বতীপুর উপজেলা কৃষি অফিসার রাজিব হুসাইন বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চলতি রোপা আমন মৌসুমে যথাসময় চারা রোপণ করায় এবং বর্তমানে ধানের অবস্থা দেখে ভালো উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ ছাড়াও কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের নানা ধরনের সহযোগিতা ও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।