দেশের অন্যতম আর্সেনিক প্রবল জেলা চাঁদপুর। একসময় স্বাস্থ্য বিভাগ ও বিভিন্ন এনজিও বিনামূল্যে রোগীদের পরীক্ষা নিরীক্ষাসহ ওষুধ প্রদান করলেও সময়ের ব্যবধানে বন্ধ হয়েছে তা। এতে করে জনমনে উদ্বেগ বাড়ছে।
জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, জেলায় পরীক্ষা করা গভীর নলকূপে আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া না গেলেও প্রায় ৯০ ভাগ অগভীর নলকূপে শনাক্ত হয়েছে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক। গভীর নলকূপ সরবরাহের পাশাপাশি পরিশোধিত নদীর পানির ব্যবহার বৃদ্ধি করা গেলে কমে আসবে ঝুঁকি। আর চিকিৎসকরা বলছেন, জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে কাজ করা হবে।
চাঁদপুরে সর্বপ্রথম ১৯৯৬ সালে শাহরাস্তি উপজেলায় শনাক্ত হয় আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী। এরপর ১৯৯৯ সালে দেশের সর্বোচ্চ আর্সেনিককবল অঞ্চল হিসেবে এ উপজেলাকে চিহ্নিত করা হয়। আর্সেনিকযুক্ত পানি পানের কারণে নীরব এই ঘাতকে আক্রান্ত হতে থাকেন জেলার হাজারো মানুষ।
শাহরাস্তির আয়নাতলী গ্রামের বাসিন্দা মীর হেলাল উদ্দিন ২০০৫ সালে আর্সেনিকে আক্রান্ত হন। ২০০৮ সালে পরীক্ষা করে জানতে পারেন আর্সেনিকের প্রভাবে তার দুটি কিডনিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এত বছর পর এখনো হাত, পা-পেটসহ শরীরজুড়ে আর্সেনিকের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে জানান দিচ্ছে কালো কালো দাগ।
তিনি বলেন, আর্সেনিক আক্রান্ত হওয়ায় শারীরিকভাবে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। দীর্ঘ ২২ বছর ধরে চিকিৎসা করছেন। এতে অনেক টাকা ব্যয় হচ্ছে। সময়ের ব্যবধানে আর্সেনিকমুক্ত নলকূপ ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে অনেকে এখনো আর্সেনিক নেই মনে করে কলের পানি পান করছেন। এটা ঠিক না। আর্সেনিক নিয়ে সচেতন না থাকলে একটা সময় পর এর জন্য মূল্য চুকাতে হবে।
উপজেলার ঠাকুর বাজার এলাকার বাসিন্দা ফয়েজ আহমেদ বলেন, আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে শাহরাস্তি পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের তালুকদার বাড়ির একই পরিবারের তিনজন মৃতু্যবরণ করেছেন। এখনও অনেকে আক্রান্ত অবস্থায় আছেন। কিন্তু ২০১২ সালের পর থেকে সরকারিভাবে ওষুধ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর্সেনিক পরীক্ষায় অনীহা বেড়েছে অনেকের। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে।
শাহরাস্তি উপজেলা স্বাস্থ্যের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. সারোয়ার হোসেন বলেন, 'জেলার সবচেয়ে বেশি আর্সেনিকপ্রবণ উপজেলা শাহরাস্তি। আমরা প্রতিনিয়ত আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী পেলেও আশার কথা হচ্ছে তা আগের তুলনায় কম। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আর্সেনিকমুক্ত পানি পানের আহ্বান জানাই। আগে আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর তথ্য উপাত্ত সংরক্ষণ করা হলেও বেশ কয়েক বছর তা হচ্ছে না।'
চাঁদপুর জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, এ জেলায় মূলত ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এর ভয়াবহতা অনুধাবন করে শুরু করা হয় নলকূপের পানি পরীক্ষা। ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে শুরু হয় সরকারিভাবে গভীর নলকূপ বসানোর কাজ। বিভিন্ন পৌরসভায় সরবরাহ করা হয় পরিশোধিত নদীর পানি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধাতির মানদন্ড অনুযায়ী প্রতি লিটার পানিতে .০১ মিলিগ্রাম পর্যন্ত আর্সেনিক থাকলে তা খাবারের জন্য নিরাপদ। তবে বাংলাদেশ সরকারের মানদন্ড অনুযায়ী প্রতি লিটারে .০৫ মিলিগ্রাম পর্যন্ত আর্সেনিক থাকলে তা খাবারের জন্য নিরাপদ। তার ঊর্ধ্বে থাকলে তা অনিরাপদ।
চাঁদপুর জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌলশ অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু মুসা মোহাম্মদ ফয়সাল বলেন, ২০২২ সালে একটি গবেষণা পরিচালনা করা হয়। এতে জেলার দুই লাখ পাঁচ হাজার ৭০টি নলকূপের পানি পরীক্ষা করে দেখা যায়, ৬০ শতাংশ অগভীর এবং বাকি ৪০ শতাংশ গভীর নলকূপ। গবেষণায় গভীর নলকূপে আর্সেনিক পাওয়া না গেলেও অগভীর নলকূপের প্রায় ৯০ শতাংশে .০৫ এর বেশি আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক জলাধারের পানিতে আর্সেনিক কিংবা আয়রন থাকে না। আর চাঁদপুর যেহেতু নদীবেষ্টিত জেলা, তাই গ্রামীণ এলাকায় গভীর নলকূপের পাশাপাশি পরিশোধিত নদীর পানি সরবরাহ বৃদ্ধি করা গেলে আর্সেনিক থেকে এ অঞ্চলের মানুষ নিরাপদ থাকবে।
তিনি জানান, জেলায় ২০১১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২২ হাজার গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। যার মধ্যে প্রায় এক হাজার টিউবয়েল ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
সিভিল সার্জন নূর আলম দীন বলেন, দীর্ঘ সময় আর্সেনিকযুক্ত পানি পানে চর্ম রোগ, টিউমার, কিডনি, লিভারের রোগসহ ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। তাই নিশ্চিত না হয়ে কোনও টিউবয়েলের পানি পান করা ঠিক নয়। যদিও গত কয়েক বছর ধরে এই রোগে আক্রান্তদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি। আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় হয়তো এই কাজে আমাদের ভাটা পড়েছে। আশা করি, এখন থেকে আক্রান্ত রোগীদের তথ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মীদের আর্সেনিকের ওপরে ট্রেনিং দেব। যাতে করে আর্সেনিকের ব্যাপারে আরও সচেতন থাকতে পারে জনসাধারণ।