নিখোঁজ জেলেদের তালিকা প্রকাশ

৩০ বছরে পাথরঘাটার ১৮৮ জেলে নিখোঁজ

ফিরে পেতে স্বজনদের আহাজারি

প্রকাশ | ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

পাথরঘাটা (বরগুনা) প্রতিনিধি
বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষা উপকূলীয় অঞ্চল বরগুনার পাথরঘাটার অধিকাংশ মানুষ মৎস্য পেশার সঙ্গে জড়িত। মাছ শিকার করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। বেঁচে থাকার তাগিদে জীবিকা নির্বাহের জন্য বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে প্রতিনিয়ত সমুদ্রে পাড়ি জমাতে হয়। জেলেরা মাছ শিকার করতে গিয়ে সমুদ্রের প্রতিনিয়তই সম্মুখীন হচ্ছেন সাইক্লোন, বন্যা, সুনামি ও জলোচ্ছ্বাসের। মাছ শিকারে গিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়ে ১৯৯৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এ ৩০ বছরে শুধু পাথরঘাটায় নিখোঁজ হয়েছেন ১৮৮ জন জেলে। নিখোঁজ জেলেদের ফিরে পেতে এখনো জেলে পলস্নীতে বিরাজ করছে স্বজনদের আহাজারি। ১৯৯৩ সালের বন্যা, ২০০৭ সালে সিডর, ২০০৮ সালে নার্গিস, ২০০৯ সালের আইলা, ২০১৩ সালে মহাসেন, ২০১৫ সালের কোমেন, ২০১৬ সালের রোয়ানু, ২০১৭ সালের রোমা, ২০২৩ সালের মিধিলিসহ এই সকল বন্যায় জেলে পরিবার হারিয়েছে তাদের প্রিয়জনকে। পাথরঘাটা উপজেলা প্রশাসনের তথ্য অনুসারে, ১৯৯৩ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বেশি সংখ্যক জেলে ২০০৭ সালের সিডরে নিখোঁজ হয়েছে। ১৯৯৩ সালে ৫ জন, ১৯৯৪ সালে ২ জন, ২০০১ সালে ৫, ২০০৬ সালে ১৪, ২০০৭ সালে ৯১, ২০১৪ সালে ৭, ২০১৮ সালে ১৩ ও সর্বশেষ ২০২৩ সালে ১৫ জনসহ এখনো পর্যন্ত মোট নিখোঁজ রয়েছে ১৮৮ জেলে। এসব নিখোঁজ জেলেদের তালিকা প্রকাশ করে সম্প্রতি পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদের সামনে স্মৃতি ফলক উন্মোচন করেছে পাথরঘাটা উপজেলা প্রশাসন। স্থানীয় জেলে সংগঠন, গণমাধ্যম কর্মী, ইউনিয়ন পরিষদ, মৎস্য দপ্তর ও পৌরসভার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে একাধিকবার যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে এ চূড়ান্ত ডাটাবেইজ প্রস্তুত করা হয়। জেলে পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বজন হারিয়ে বিভিন্ন রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাদের। নিখোঁজদের কোনো মৃতু্য সনদ না থাকায় পরিবারের জমি বিক্রিসহ বিভিন্ন ধরনের জটিলতায় পড়তে হচ্ছে স্বজনদের। নিখোঁজ জেলেদের স্ত্রীরা পাচ্ছেন না সরকারি সহায়তা অথবা বিধবা ভাতা। ১৯৯৩ সালে নিখোঁজ কালমেঘার জেলে হারুন সরদারের মা জবেদা বলেন, 'আমার ছেলে একটি ট্রলারে গভীর সমুদ্রে মাছ শিকারে যায়। ঝড়ের কবলে পড়ে ট্রলারটি সমুদ্রে ডুবে যায়। আমার ছেলে বেঁচে আছে না মরে গেছে তাও জানি না। ছেলে নিখোঁজের পর তার স্ত্রী দুই সন্তানকে রেখে দুই মাস পর বাবার বাড়ি চলে যায়। অন্যের বাড়ি কাজ করে আমি এই দুই সন্তানের খাবারের ব্যবস্থা করি। এখন তারা কর্মের উদ্দেশে চট্টগ্রাম রয়েছে। ৩০ বছর নিখোঁজ থাকার পরেও পাইনি সরকারি কোনো অনুদান।' ২০১৪ সালে স্বামীসহ দুই সন্তানকে হারিয়েছেন চরদুয়ানীর রানী বেগম। তিনি বলেন, 'আমার স্বামী ইসমাইল ফরাজীকে হারিয়েছি। সঙ্গে দুই ছেলে সাইকুল ও শহিদুলকেও হারাই। জানি না তারা বেঁচে আছে না মরে গেছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর দুই পত্রবধূ চলে যায় বাবার বাড়ি, পরে তারাও অন্যত্র বিয়ে করে। আমি অন্যের বাড়িতে কাজ করে চলি।' বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী জানান, জীবিকার তাগিদে প্রতিদিনই ট্রলারে ঝুঁকি নিয়ে মাছ শিকারের জন্য নদী, মোহনা, সাগর ও গভীর সাগরে গমন করেন বিভিন্ন জেলে। বড় তিনটি নদী ও সমুদ্র উপকূলবর্তী উপজেলা হওয়ায় যে কোনো বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এই পাথরঘাটায় প্রথম আঘাত হানে। এর ফলে প্রতি বছরই জেলে ও মাছ ধরার ট্রলার নদী, মোহনা, সমুদ্র ও গভীর সমুদ্রে নিখোঁজ হয়। পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ রোকনুজ্জামান খান নিখোঁজ জেলেদের ডাটাবেইজ করে একটি স্মৃতি ফলক স্থাপন করায় আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। পাথরঘাটা উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এই অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষই মৎস্য পেশার সঙ্গে জড়িত। নিখোঁজ জেলেদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। যাদের নিখোঁজের ছয় মাস শেষ হয়ে গেছে ওই সব জেলে পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে আর কিছু একটা করার চেষ্টা চলছে। পাথরঘাটা ইউএনও রোকনুজ্জামান খান বলেন, নিখোঁজ জেলেদের নামসহ উপজেলা পরিষদের মধ্যে একটি মু্যরাল তৈরি করা হয়েছে। যাতে করে দেখলেই বোঝা যায় যে, এ উপজেলার কতজন জেলে নিখোঁজ। নিখোঁজ জেলেদের তালিকা প্রস্তুত করে রেশন ও আর্থিক সহায়তাসহ তাদের জমি বিক্রির জন্য একটি সনদ দেওয়ার কথা চলছে।